1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ০২:০৬ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

লাঙ্গলের ফলায় জাগে দ্রোহের বারুদ : সুখেন্দু সেন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৭

মানব সভ্যতা বিকাশের আদি কারিগর, প্রকৃতির নিবিড় শিল্পী, লাঙ্গলের ফলায় মাটির বুকে যারা সৃষ্টি করে জীবনের শিল্প, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেই শিল্পী, সেই প্রকৃতি যোদ্ধার নামের সাথে যুক্ত হয়ে আছে অভাগা কৃষক, হতভাগ্য কৃষক, দুর্ভাগা কৃষক। ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটেছে অনেক আগেই। নেই জমিদারি ব্যবস্থার শোষণ, তবুও উপনিবেশিক চেতনায় প্রভাবিত শিক্ষিতদের কাছে এরা ব্রাত্যজন। নামের সাথে সন্নিবেশিত তকমা দীর্ঘ হয়ে কখনো আবার যুক্ত হয়েছে মূর্খ চাষা-ভুষা। শ্রেণি ও পেশায় নাগরিক সমাজে এরা অপাঙ্ক্তেয়। অথচ এরাই নিরন্তর সংগ্রামে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীত উপেক্ষা করে আপন সুখ-শান্তির নির্মোহ বিসর্জনে মাটি চিরে ফসল ফলায়, যোগায় মুখের গ্রাস। এখন পর্যন্ত দেশের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে এদেশের কৃষি এবং কৃষক। প্রকৃতিনিবিড় এই যোদ্ধাদের কোনো ছুটি নেই, ধর্মঘট নেই, নেই ইনক্রিমেন্ট, বোনাস, পদোন্নতি। তবুও এরা খেটে যায় সময় মেপে নয়, ফাঁকি দিয়ে নয়, খাটে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। পরিশ্রম করে উদয়াস্ত। তবু শেষ রক্ষা হয় না।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক রূপান্তরে অগ্রগতি ঘটে চলেছে। দাতা সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের ঘোরতর বিরোধিতার মুখেও কৃষি উপকরণসহ সারে ভর্তুকি মূল্যে যথাসময়ে যোগান নিশ্চিত করে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধির সূচনা করে তা অব্যাহত রেখেছে এই সরকার। কৃষকের শ্রম-ঘাম এবং সেই সঙ্গে সরকারের সংবেদনশীল ও কার্যকরী নীতির ফলে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ এবং কতিপয় অসাধু-অতিলোভীর খপ্পরে অনেক অর্জনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। বিশেষ করে এক ফসলি হাওর অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্যে প্রায় প্রতিবছরই নেমে আসে দুর্ভোগ। হাওর রক্ষার নামে প্রতি বছরের বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি এখন লোভ-লালসার মাত্রা ছাড়িয়ে নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কখনো হিংস্রতার রূপও নেয়। বাঁধ নির্মাণের কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ কতিপয় দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী, অসাধু ঠিকাদার, পিআইসি সংশ্লিষ্টদের লুটপাটের মহোৎসবের সুযোগ করে দিলেও অভাগা কৃষকের ভাগ্য আটকে থাকে নিয়তির চিরকালীন বঞ্চনায়।
বানের জল ঠুনকো বাঁধ ভেঙে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই হাওরে প্রবেশ করে ডুবিয়ে দেয় ফসল, সেই সাথে ডুবে যায় কৃষকের স্বপ্ন-সাধ। এ বছরের অকাল বানেও তলিয়ে গেছে সুনামগঞ্জ জেলার ছোট-বড় প্রায় সবক’টি হাওর। দীর্ঘদিনের কঠোর শ্রম আর সন্তান বাৎসল্যে সযতœ পরিচর্যা শেষে ফসল তোলার প্রতীক্ষায় যখন উন্মুখ হয়ে থাকে কৃষক, সেই অন্তিম মুহূর্তে চোখের সামনে তখন ডুবতে থাকে স্বপ্নের ফসল। অসহায় কৃষক হাওর রক্ষার বরাদ্দ আর বাঁধ রক্ষাকারীর অপেক্ষায় না থেকে শেষ চেষ্টায় নিজেদের উজাড় করে দিয়ে শেষ সম্বল নিয়ে শেষ সংগ্রামেও যখন অসহায়ভাবে ব্যর্থ হয় তখন তার বুকে অনুভূত হয় সন্তান হারানোর বেদনা। বদলে যায় হাওর পাড়ের চিত্রপট। এ মুহূর্তে গ্রামে গ্রামে যখন ফসল তোলার উৎসবে মুখরিত হওয়ার কথা সেখানে নামে শ্মশানের নীরবতা। হাওরের বাতাসে কেবল অনুরণিত হয় বুকভাঙা কৃষকের হাহাকার।
সেই পাকিস্তান আমলের প্রথম থেকেই বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান ছিল পূর্ব বঙ্গবাসীর প্রাণের দাবি। চুয়ান্ন’র যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের ছাত্র সংগ্রামের ১১দফার অন্যতম দাবি ছিল এটি। সেই সঙ্গে যুক্ত ছিল খাল-খনন, নদী খনন, সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদ, ভূমি সংস্কার, মহাজনের কবল থেকে কৃষকদের রক্ষার আনুষাঙ্গিক প্রস্তাবনা। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কৃষি ক্ষেত্রে অনেকাংশেই অগ্রগতি সাধিত হলেও বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। উদ্যোগ নেয়া হয়নি হাওর রক্ষার সুপরিকল্পিত ও টেকসই সমাধানের। গ্রাম্য মহাজনদের খপ্পরে পড়ে আজো ভিটে মাটি ভূমি হারিয়ে নিঃস্ব হয় কৃষক। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ থাকলেও ফসল বীমার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি আজো। তাই ঋণে সৃষ্ট ফসল প্রাকৃতিক দুর্যোগে হারিয়েও কৃষকেরা পায়না কোনো ক্ষতিপূরণ। উপরন্তু বাড়ে ঋণের বোঝা। সাহায্যের নামে সেই পরিশ্রমী কৃষকযোদ্ধাদের সান্ত্বনা দেয়া হয় কেবল ন্যায্য মূল্যের চালের লাইনে টেনে এনে। প্রতিবাদের শক্তি আর ভাষাও তারা হারিয়ে ফেলে। ‘চাষা-ভুষা’দের অসহায়ত্ব আর অসমর্থতার সুযোগ গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন সুবিধাবাদী রাজনীতিক আর সুচতুর আমলারা। নিরাপদ আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারেরা।
চোখে যাদের ঠুলি বাঁধা তাদেরই কেবল বোধগম্য হয় না এদেশের কৃষকেরা অশিক্ষিত হলেও মূর্খ নয়। প্রকৃতির কাছে তাদের নিয়ত পাঠ। খেয়ালি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করেই তাদের নিরন্তর জীবন সংগ্রাম। তারা ফসলের ভাষা বুঝে। মাটি-কাদা-জলের সাথে তাদের নিত্য কথোপকথন। তারা বুঝে রাজনীতির ভাষাও। আর তা বুঝে বলেই একাত্তরের রণাঙ্গনে লাঙল ছেড়ে রাইফেল হাতে যারা প্রকৃতপক্ষেই সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সিংহভাগই এই ব্রাত্যজনের প্রতিনিধি; কৃষক এবং কৃষক সন্তান। বাংলার পলিল মৃত্তিকায় তাদের রক্তই মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে এদেশের কৃষক সমাজের। এক সময় তারাই ঘটিয়েছে রক্তাক্ত কৃষক বিদ্রোহ। করেছে তেভাগা আন্দোলন, নানকার বিদ্রোহ। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম বেহেলী সাক্ষী হয়ে আছে অবিভক্ত ভারতে আসামের রাজধানী শিলং পর্যন্ত কৃষকের ঐতিহাসিক লংমার্চের। এখানেই শেষ নয়। স্বাধীন দেশেও ধানের শীষ মার্কা সরকারের আমলে সারের ন্যায্য দাবিতে সরকারি বাহিনীর উদ্ধত রাইফেলের সামনে বুক চিতিয়ে দিয়ে রক্তের আল্পনা এঁকেছে এদেশের সংগ্রামী কৃষক।
বাংলার কৃষকেরাই নিরন্তর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন দেশে এরা প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধে ব্রতী। একাত্তরে যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার এ রকমই একটি পোস্টার প্রচার করেছিল, ‘বাংলার প্রাণ, একমুঠো ধান ফলানোর নামÑ স্বাধীনতা সংগ্রাম’। সে সংগ্রাম তো চলতে থাকবে যতদিন কৃষি আছে, কৃষক আছে। এর শেষ নেই।
কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতা বলতে ‘ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি’কেই বুঝিয়েছেন। সে কৃষকের মুখের হাসি মুছে গেলে স্বাধীনতার কী আর অর্থ থাকে। যারা কৃষকের মুখের হাসি মুছে দিল, মুখের গ্রাস কেড়ে নিল, স্বাধীনতার অর্থটাকেই ম্লান করে দিল, নিরন্তর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী রাজাকার তো এরাই। ফসল রক্ষা কৃষকের ন্যায্য অধিকার। যারা তাদের সে অধিকার বঞ্চিত করেছে সেই নব্যবর্গী লুটেরাদের বিরুদ্ধে সঞ্চিত ক্ষোভ তো বারুদ হয়ে জ্বলবেই।
হাওর রক্ষা, ফসল রক্ষার প্রশ্নে কোন আপোস নয়। বিভেদের কোন প্রশ্নই তো তোলার অবকাশ নেই। আর বিলম্ব নয়, ঐক্যবদ্ধ হয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনই। আশ্বাস আর সান্ত¦নার বাণীতে জোড়া লাগবেনা কৃষকের ভাঙা বুক। দেশপ্রেমিক রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, পানি বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং ভুক্তভোগীদের সমন্বয়ে স্থায়ী সমাধান সূত্র খোঁজে বের করা হোক এখনই। এটিই সময়ের দাবি। নববর্ষে এই হোক অঙ্গীকার।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com