মো. আমিনুল ইসলাম ::
দাম্পত্য কলহ নিয়ে দিনাতিপাত করে আসছিল মহিন ও চুমকি। বিয়ের পর থেকে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় কথা কাটাকাটি। এ ধরনের ঝামেলা দিন দিন বাড়তেই থাকে। বিয়ের আগে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও বিয়ের পর তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় কলহ। রম্য নাটকে দু’জনেই অভিনয় করতেন। কোন কোন সময় চুমকি গানও করতেন বলে লোকমুখে তিনি পরিচিত ছিলেন। সংসারের ঝামেলার ব্যাপারে চুমকি তার মায়ের কাছে জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেছিলেন তার ঘরের আসবাবপত্র মায়ের বাড়িতে নিতে হবে। এজন্যে নৌকার প্রয়োজন আছে বলেও চুমকি উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু প্রেমের টানে বিয়ে আর বিয়ের পর সংসার পর্যন্ত এগিয়ে একটা অপমৃত্যুতে জীবনের সমাপ্তি টানেন চুমকি। শহরের আবাসিক একটা হোটেল থেকে তার মরদেহ উদ্ধারের মধ্য দিয়ে ‘চুমকি জীবনে’র গল্পটির ইতি ঘটে।
এ ঘটনাটি নিয়ে শহরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রথমে মহিন আর চুমকির মধ্যকার স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটি নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা সন্দেহ থাকলেও পরে জানা যায় তারা প্রকৃতপক্ষেই এ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। চলতি মাসের ১৩ তারিখে শহরের পুরাতন বাসস্টেশন এলাকার হোটেল আল হেলাল ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটে যাওয়া চুমকি হত্যাকান্ড নিয়ে মুখ খুললেন ঘাতক মহিন। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে অজানা অনেক কথা।
গত ২২ মে রোববার দুপুরে আদালতের কাছে ঘটনাটির ব্যাপারে জবানবন্দি দেন মহিনুল ইসলাম মহিন। সে এসময় নিজের দোষ স্বীকার করে। পুলিশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন সে আদালতের বিচারকের কাছে হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে নিয়ে ঘটনার বর্ণনা করে। এসময় মহিন জানায়, তার স্ত্রীর আচার-আচরণ নিয়ে তাকে লোকে বলাবলি করতো, এজন্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাই তাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। জানা যায়, মহিন চুমকিকে বিয়ে করলেও মহিনের পরিবার এ বিয়ে মেনে নেয়নি। এজন্যে সে চুমকিকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতো। সে কয়েকটি বাসাও পাল্টিয়েছিলো। বিয়ের একবছর হতে না হতে চুমকি আর মহিনের কলহের মাত্রা সীমা ছাড়ায়। তাদের মধ্যে প্রায়ই হাতাহাতির ঘটনাও ঘটতো বলে পরিবারের সূত্রে জানাগেছে।
পারিবারিক কলহের বিষয়টি চুমকি হত্যাকান্ডের পর থানায় দায়েরকৃত মামলায়ও উল্লেখ করেন চুমকির মা।
আদালতের কাছে জবানবন্দি দিতে গিয়ে ঘাতক মহিন উল্লেখ করে, ১৩ মে চুমকিকে হত্যা করা হয় ভোর ৬টায়। হোটেলে ওঠার আগে ১২ মে রাতে সিলেট থেকে মহিন সুনামগঞ্জে পৌঁছে। চুমকি সুনামগঞ্জেই ছিল। রাতে শহরের পুরাতন বাসস্টেশন এলাকার ডাচ বাংলা ব্যাংকের সামনের সড়কে তাদের দেখা হয়। তারা বাসায় থাকবে কিনা এ নিয়ে কিছু সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন দু’জনই। পরে রাত ১১টার দিকে তারা হোটেল আল হেলাল ইন্টারন্যাশনালে কক্ষ ভাড়া নিতে যান। নিচতলার একটি কক্ষ ভাড়া নেয়ার পর রাতে দু’জনে আর কখনো দাম্পত্য কলহে জড়াবেন না বলে কথা হয়। কিন্তু ভোর ৬টার দিকে কক্ষ থেকে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে যেতে চান মহিন। এসময় চুমকি ও মহিনের মধ্যে আবারো কথা কাটাকাটি শুরু হয়। একপর্যায়ে মহিন চুমকিকে মারধরও করে। পরে চুমকির গলায় থাকা ওড়নাকে দুইদিকে টেনে ধরে মহিন। আর এতে করে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন চুমকি আক্তার। চুমকিকে হত্যা করার পর কক্ষটি বাহিরের দিকে তালাবদ্ধ করে নাশতা আনার কথা বলে পালিয়ে যায় মহিন।
১৩ মে শুক্রবার সকালে হোটেল কর্মীদের সন্দেহের সূত্র ধরে পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে উদ্ধার হয় চুমকির মরদেহ। ওইদিন লাশ ময়না তদন্ত শেষে দাফনকার্য সম্পন্ন হলেও থানায় কোন মামলা দায়ের হয়নি। পরদিন দুপুরে চুমকির মা বাদী হয়ে মহিনকে একমাত্র আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এঘটনায় মহিন কিছুদিন পলাতক থাকার পর ১৬ মে সোমবার আদালতে আত্মসমর্পণ করে। পরে তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন আদালত। পরবর্তীতে মহিনের কাছ থেকে হত্যাকান্ডের আরো তথ্য জানতে আদালতের কাছে ৭দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত ২দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে পুলিশের কাছেও হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে ঘাতক মহিন।
সর্বশেষ গত ২২ মে রোববার আদালতের কাছে হত্যাকান্ডে নিজের দোষ স্বীকার করে ঘটনার বর্ণনা করে মহিন। মহিনের জবানবন্দি ও তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন হত্যা মামলার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা এসআই সাইদুজ্জামান।
এ বিষয়ে সদর মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘চুমকি হত্যাকান্ড নিয়ে আদালতের কাছে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে মহিন।’