মো. আমিনুল ইসলাম ::
‘রাইত নামে আর আমরার আলগা একটা ডর বাড়ে, নিজের রিকশার হেন্ডেল ধইরা রাখা আর পাও দিয়া পেডেল মারা তো আছেই, তার উপরে আবার চউখ দুইটা বড় বড় কইরা চাইয়া থাকন লাগে, কোন বায়দি যে অটোরিকশা আইয়া উপরে উঠিযায় তার ঠিক নাই ভাই, বিপদে খালি আমরা একলা না, রাস্তার মানুষের একটা বিপদের নাম ‘লাইট ছাড়া অটো’, কেমনে যে এরা আইন্ধাইর রাস্তায় চলে? আমরা তো আস্তে আস্তে চালাই, এরা ছুটে বিমানের লাখান, লাইট নাই – হরন নাই- কোন সিগন্যাল নাই- একটু আস্তে গেলে কিতা অয় রে বাবা?’ কথাগুলো একজন রিকশা চালকের।
তিনি শহরের ষোলঘর এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম। বৃহস্পতিবার রাতে শহরের আলফাত স্কয়ার এলাকায় এ প্রতিবেদকের কাছে এ কথাগুলো বলেন তিনি। প্রসঙ্গ ছিল- ‘বাতিবিহীন অটোরিকশা’। তাঁর মতে রাতের আধাঁরে বাতি ছাড়া অটোরিকশাগুলো যেনো মৃত্যুদূতের মতোই। আচমকা সড়কের বিভিন্ন মোড় থেকে বেরিয়েই সামনে এসে পড়ে। তখন আর কিছু করার থাকে না।
রাতের বেলা বাতি ছাড়া এসব অটোরিকশার ব্যাপারে শহরের সাধারণ মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ কেবল বাতি না থাকার জন্যই নয়। সড়কের অতিরিক্ত সংখ্যক অটোরিকশাগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই নেই হর্ন। নেই লুকিং গ্লাস, সিগন্যাল লাইট ও ফিটনেস। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সমূহে ছুটে চলছে এসব অটোরিকশা। বিশেষ করে ওয়েজখালি, নতুন বাসস্টেশন, আব্দুজ জহুর সেতু, মল্লিকপুর, হাজিপাড়া, নতুনকোর্ট, পুরাতন বাসস্টেশন হয়ে কালীবাড়ি মোড় ও আলফাত স্কয়ার পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করছে এসব অটোরিকশা।
অন্যদিকে শহরের স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকা থেকে উকিলপাড়া, কাজিরপয়েন্ট, ষোলঘর পয়েন্ট, ধোপাখালি-নবীনগর হয়ে হালুয়ারঘাট এলাকায় চলছে বেশ কিছু অটোরিকশা। এছাড়াও আরো কিছু অটোরিকশা চলছে হাছননগর এলাকার সদর হাসপাতাল, সরকারি কলেজ, ময়নার পয়েন্ট, ভুবির পয়েন্ট, হাছননগর বাজার, বেতগঞ্জ, বুড়িস্থল, বিহারি পয়েন্ট, হোসেন বখত চত্বর, মহিলা কলেজ রোড, কালিবাড়ি পয়েন্ট হয়ে সদর মডেল থানা পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকায়।
অটোরিকশা চলাচলে নানা অনিয়ম ও ভোগান্তি নিয়ে শহরের সাধারণ শ্রেণি পেশার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তাদের মতে, ড্রাইভিংয়ের ব্যাপারে কোন ধরনের অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ না থাকার পরেও শিশুদেরকে দেখা যাচ্ছে এসব অটোরিকশার চালকের ভূমিকায়। জেলা শহরের এসব অটোরিকশা মালিক ও শ্রমিকরাও দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের সদস্যরা যুবদল নেতা সোহেল আহমেদ নেতৃত্বাধীন সমিতির সদস্য। আরেকটি ভাগে রয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থক সিরাজুর রহমান সিরাজ নেতৃত্বাধীন সমিতির সদস্যরা।
এ দুই পক্ষ শহরের ইজিবাইক শ্রমিকদের কাছে ‘নতুন সমিতি’ ও ‘পুরাতন সমিতি’ হিসেবে পরিচিত। সোহেল আহমদের নেতৃত্বাধীন সমিতিকে পুরাতন সমিতি হিসেবে জানেন অটোরিকশার শ্রমিকরা। দুই সমিতি থেকে পাওয়া তথ্যের সূত্র অনুযায়ী, শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে প্রতিদিন চলছে কমপক্ষে সাড়ে ৫শত অটোরিকশা। এরমধ্যে বৈধ কাগজপত্র রয়েছে ৪১৮টির। আর বাকিগুলোর কোন কাগজপত্র নেই।
তবে সদর ট্রাফিক অফিসের দেয়া তথ্য মতে, শহরে একসঙ্গে সাড়ে ৫শত অটোরিকশা নিয়মিত চলাচল করছে না। ট্রাফিক পুলিশের মতে, রাতের বেলা বাতি না জ্বালিয়ে অটোরিকশা চলাচল সম্পূর্ণ বেআইনি।
বাতিবিহীন অটোরিকশার ব্যাপারে মীর হোসেন বলেন, ‘শহরে অটোরিকশা বেশি হইগেছে, অনেক অটোরিকশার ড্রাইভার দেখছি বাইচ্চা পোলাপান। এরা কোনসময় রিকশাই চালায় নাই। কিছু অটোরিকশায় দেখছি কোন সিগন্যাল না দিয়াই মোড় নেয়। আর কিছু অটোরিকশা তুফানের লাখান চালাইয়া যায়। ব্রেক নাই, লাইট নাই, হরন নাই, এরার চালানি দেখলেই ডর লাগে, ডেইলি কোন না কোন এলাকায় দুর্ঘটনা আছেই।’
অটোরিকশা চালক সাইফুদ্দিন বলেন, ‘আমরা লাইট না থাকলে রাস্তায় চলাচল করতে সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক অটো আছে যারা ব্যাটারির চার্জ বাচাইতে গিয়া লাইট জ্বালায় না। এইটা যে কতোবড় দুর্ঘটনার কারণ হয় সেইটা চিন্তা করে না। যারা রাইতের বেলা লাইট না জ্বালাইয়া অটো চালায় তারার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত’।
অটোরিকশা সমিতির এক অংশের সভাপতি সিরাজুর রহমান বলেন, ‘শহরে সাড়ে ৫শ অটোরিকশা চলাচল করে, এরমধ্যে ৪১৮টির বৈধতা আছে। আমরা আমাদের সমিতির সকল সদস্যকে রাতের বেলা বাতি জ্বালিয়ে অটো চালাতে বলেছি। পাশাপাশি হর্ন, সিগন্যাল ও দক্ষ চালক দিয়ে অটো পরিচালনা করতে মালিকদেরকে বলে থাকি। আমরা ১৮ বছরের নিচে কাউকে আমাদের সমিতির সদস্য কার্ড দিচ্ছিনা, শহরে নতুন নতুন অটো নামছে এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। অতিরিক্ত অটোরিকশা শহরে যানজটের সৃষ্টি করছে। অনেকেই নিয়মের কোন তোয়াক্কা করছেন না’।
অটোরিকশা সমিতির আরেক অংশের সভাপতি সোহেল আহমদ বলেন, ‘বাতি ছাড়া কোনভাবেই সড়কে অটোরিকশা চালানো যাবেনা এ কথা আমি আমার সমিতির সকল সদস্যকে জানিয়ে দিয়েছি। শহরে অন্য আরেকটি অটোরিকশা সমিতি রয়েছে। আমরা আমাদের সকল সদস্যকে আইন মেনে অটো চালাতে নির্দেশ নিয়েছি, ফিটনেস টা তেমন কোন বিষয় না। ব্যাটারির উপর নির্ভর করে অটোরিকশা ভালো না খারাপ। তবে অবশ্যই রাতের বেলা লাইট না জ্বালিয়ে অটো চালানো যাবে না, নিয়ম মেনেই সকলকে চলতে হবে,।
ট্রাফিক সার্জেন্ট সালাউদ্দিন কাজল বলেন, ‘শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যেসব অটোরিকশা চলাচল করছে তাদেরকে অবশ্যই রাতের বেলা আলো জ্বালিয়ে চলতে হবে। কারণ যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি হর্ন, সিগন্যাল ঠিক থাকতে হবে, নিয়ম মেনে চলতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কোন চালক অটোতে থাকতে পারবে না। আমরা শীঘ্রই শহরের বাতিবিহীন অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবো। শহরের সড়কগুলোতে একসাথে সাড়ে ৫শ অটোরিকশা চলাচল করছে না, বিভিন্ন সময়ে তারা সড়কে নামছে। তবে যে সংখ্যক অটোরিকশা আছে তাদের ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা হলো সকলকেই ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। অন্যথায় তাদের ব্যাপারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’