‘একটি জরুরি সরকারি ঘোষণা- অদ্য সন্ধ্যা সাতটা থেকে সুনামগঞ্জ শহরে কারফিউ জারি করা হল। সাতটার পর রাস্তায় কাউকে পেলে গুলি করা হবে… আদেশক্রমে, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ।’
২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মাইকে এই ঘোষণা শুনে শহরের মানুষ হতবাক হয়ে পাড়ায় পাড়ায়, রাস্তার মোড়ে জটলা করে আলাপ আলোচনা করতে থাকে।
প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট পরে একই মাইক থেকে আওয়াজ শুনা যেতে লাগলো, সুনামগঞ্জের মানুষের চির পরিচিত কণ্ঠস্বর সাব্বির আহমদের ঘোষণাÑ ‘প্রিয় শহরবাসী, পাকসেনারা সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেছে। এদের রুখতে হবে, জীবন দিয়ে হলেও এদেরকে বাংলার বুক হতে তাড়াতে হবে। আপনারা মনোবল অটুট রাখুন।’ এই ব্যাপারে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ শীঘ্রই ঘোষণা দিবেন।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় গাড়ির হেড লাইট নিভিয়ে ঝড়ের গতিতে সুনামগঞ্জ থানায় প্রবেশ করে পাকসেনারা। গাড়িতে ১১জন পাকিস্তানি সেনা ছিল। এদের কমান্ডে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব নামে এক বাঙালি অফিসার। তারা থানায় প্রবেশ করার পর থানা কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। তারা প্রথমেই মহকুমার জনসংযোগ অফিসারকে ডেকে বলে যে, তাড়াতাড়ি কারফিউ জারির ঘোষণা দেওয়ার জন্য। জনসংযোগ অফিসার নির্দেশ পেয়েই অফিসে গিয়ে দেখেন যে অফিসে কেউ নেই, সব পালিয়েছে। প্রাণের মায়ায় তিনি রিকশাতে মাইক বেঁধে নিজেই প্রচার কার্যে লেগে যান।
উকিলপাড়ার শেষ মাথায় যাওয়ার পর সাব্বিরের সাথে উক্ত কর্মকর্তার দেখা হয়। সাব্বির ও তার সহযোগী বন্ধুরা জনসংযোগ কর্মকর্তাকে পেদানি দিয়ে মাইক কেড়ে নেন। সেই মাইক থেকেই সাব্বির সংগ্রাম পারিষদের পক্ষ থেকে পাল্টা ঘোষণা শুরু করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি তৃতীয় ব্যাচে প্রশিক্ষণ নিয়ে টেকেরঘাট সাব সেক্টরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার পিতা আকমল আলী সাহেবকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত ¯স্নেহ করতেন। তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।
সাব্বির আহমদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। অনেক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নাটকে অংশগ্রহণ করতেন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, ২০০০ সালের পরে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ থেকে নামছিলাম, হঠাৎ খালি পা- আটপৌরে ফ্রক পরিহিত একটি মেয়ে আমাকে বলল দাঁড়ান চাচা, আমি মুক্তিযোদ্ধা সাব্বির আহমেদের মেয়ে। আমি আপনাদের সব সভায় খবর পেলে আসি। এই হলেই এক সভায় আপনি বলেছিলেন, সুনামগঞ্জের সব মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার পর আপনি, সালিক চাচা ও সাইদুর রহমান চাচা ভাতা নিবেন। কিন্তু জানতে পারলাম আপনারা সবাই ভাতা পেয়েছেন কিন্তু আমার বাবা তো আপনাদের সাথে ছিলেন, একসাথে যুদ্ধ করেছেন কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়েও কেনো ভাতা পেলাম না? আমার বাবা কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? আমার দাদা আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন, বঙ্গবন্ধু স্বয়ং তাকে নিয়ে একসাথে ভাত খেতেন। তিনিও কোনো সুযোগ-সুবিধা নেননি কিন্তু এখন আমরা অসহায়। আমাদের সাথে আপনাদের এমন ব্যবহার কেনো? সাব্বিরের মেয়ের কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
এই মেয়ে তো আমারও হতে পারতো। সেদিন আমি তার কথার জবাব দিতে পারিনি…।
এই সমস্ত ভাতা দেওয়া যাদের দায়িত্ব তাদের কাছে সবিনয় আবেদন করছি, সরকার কোটি কোটি টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করছেন এবং এই সমস্ত কাজ করার জন্য তিন তলা চার তলা সুরম্য ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন। আপনারা দয়া করে সাব্বিরের মত ভাতাবঞ্চিতদের ভাতার ব্যবস্থা করুন এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যারা ভাতা পাচ্ছে তাদের ভাতা বন্ধ করুন।