1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ০৫:০৮ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরর্ণাথী ৭১

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বিহারের খেলাটি আরেক ইতিহাস। বিহারীরা বাঙালিদের প্রতি কী রূপ বিক্ষুব্ধ ছিল তার ধারণা পেতে হলে যেতে হবে সিওয়ানের ফুটবল খেলা দেখতে। না, আমি যাইনি। তবে এটি ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তানে বিহারীদের হত্যা করা হচ্ছে এমন প্রচারণায় বিহারীদের মনোভাব প্রচন্ড বাংলাদেশবিরোধী। প্রথমে স্বাধীন বাংলা দলের সাথে খেলতেই অস্বীকৃতি জানায় সিওয়ানের বিহারীরা। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য এ ধরনের আয়োজন ছিল জরুরি- বিশেষ করে বিহার রাজ্যে। ম্যাচ ড্র হবে এমন শর্তে খেলতে রাজি হয় সিওয়ান ফুটবল একাদশ। প্রচারণার স্বার্থে এমন অলিখিত চুক্তি মেনে নিয়েই খেলে বাংলাদেশ। মাঠের দর্শকদের বেশিরভাগই স্থানীয় বিহারী। খেলা চলছে কোনো দিকেই গোল নেই। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে। মধ্যমাঠ থেকে সালাউদ্দিনের লম্বা এক শর্ট ঢুকে যায় সিওয়ানের জালে। আর অমনি শুরু হয়ে গেল লঙ্কাকান্ড। দর্শকরা মাঠে ঢুকে তেড়ে এলো বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের প্রতি। আত্মরক্ষার্থে যে যেদিকে পারে ছুটছে পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে নেয় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের। নিবৃত করে হিং¯্র বিহারীদের। এই সেই বিহার। যেখানকার লোকজন ৪৭-এর পর মোহাজের হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিল। এদের জাত ভাইরাই এখন পাকবাহিনীর সহযোগী হয়ে তান্ডব চালাচ্ছে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, সীতাকুন্ড, ফিরোজ শাহ কলোনি, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, খুলনা, সৈয়দপুরে।
আমার মাথায় তখন অন্য এক ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সাথে ঘুরছি আমিও। একটা কিছু করার দরকার। চেষ্টাও করছি। ছাত্রসংগ্রাম সহায়ক সমিতির যে কাজ তাতে মন ভরছে না। তবে বলার মতো কাউকে পাচ্ছি না। কলকাতায় আশ্রয়গ্রহণকারী রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক তাদের কারো সাথেই কোনো পরিচয় নেই। মুখও চিনি না। আর নিজেরও পরিচয় দেয়ার মতো কিছু নেই। আমাদের নেতা, এমপিরা সবাই মেঘালয়ে।
মুজিবনগর সরকারের দু’একটি কার্যালয় কয়েকজন নেতার আস্তানা অনেক কষ্টে খুঁজে বের করতে পেরেছি। ছোটখাট নেতাদের সাথে কখনো কখনো আলাপের সুযোগ হয়। অনেকে মুখেমুখেই কেবল টিক্কা, ভুট্টো নিধন করছেন। ভাব দেখান সবজান্তার, কাজ দেখান মস্ত বড়ো। বুঝা যায়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদও তাদের পরামর্শ ছাড়া কিছু করেন না। আবার কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে জ্ঞান-গরিমা সব ফাঁস হয়ে যায়। বলতে পারেন না কিছুই। ওদের উপর আমার তেমন ভরসা নেই। বুঝতে পারি এরা এখানে এমএনএ, এমপিএ, প্রভাবশালী নেতাদের উপর ভর করে বসে বসে অন্নই ধ্বংস করছে। দুই তিনদিন এদেরকে একইভাবে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে মেঝেতে বিছানা পেতে কেউ বসে কেউ শুয়ে থাকতে দেখেছি। বড় নেতাদের কেউ কেউ কলকাতায় বেশ বিলাস ব্যাসনে আছেন। কাজের কাজ কিছু না করতে পারলেও দলাদলি কোন্দল ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত রয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচএম কামরুজ্জামানকে তাঁর ঘনিষ্ঠ এবং এলাকার কিছু নেতা প্রায়ই কানভারি করছেনÑ তাজউদ্দিন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হন কি করে। আপনি পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আর তাজউদ্দিন সাহেব পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের। প্রধানমন্ত্রী তো আপনারই হওয়ার কথা। কামরুজ্জামান সাহেব ধৈর্য্য ধরে নীরবে শুনেন। একদিন ধীরস্থিরভাবে বললেনÑ বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র, পরিবার ফেলে রেখে প্রাণ বাঁচাতে শরণার্থী হয়ে এখানে এসেছেন। কিন্তু চরিত্রটা সেখানে রেখে আসতে পারলেন না। দৃঢ়ভাবে বললেনÑ দেশ স্বাধীন করুন আগে। তারপর ফিরে গিয়ে যতোখুশি দলাদলি করুন। সকলেই পরে নিবৃত হলেন।
বড় বড় নেতাদের কাছে পাত্তা পাওয়া যায় না। বয়স এবং আকার-আকৃতি অনেকেরই মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়। আব্দুস সামাদ আজাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে ঘুরতে ঘুরতে একদিন চলে এসেছিলাম ওরিয়েন্ট রোডে। ভরসা ছিল পরিচয় দিলে চিনতে পাররেন। নির্বাচনে জেতার ক’দিন পর সুনামগঞ্জ এসে কলেজ সম্পর্কে তথ্য নেয়ার জন্য আমার কাকা’র সাথে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলেছিলেন। মহকুমার একমাত্র কলেজ সরকারিকরণের বিষয়টি তিনি পার্লামেন্টে উত্থাপন করবেন। কথায় কথায় পার্লামেন্ট বসবে কিনা, সরকার গঠন করা যাবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছিলেন আব্দুস সামাদ স্বয়ং। এমন আলোচনায় শ্রোতা হিসেবে আমিও উপস্থিত ছিলাম। ওরিয়েন্ট রোডের বাসায় উনাকে পাওয়া যায়নি। মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য মুজিবনগর সরকারের দূত হয়ে তিনি চষে বেড়াচ্ছেন একদেশ থেকে অন্যদেশ। এখানে খুব কমই থাকেন। হাঁটতে হাঁটতেই ফিরলাম। এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করাও কম ঝক্কির নয়। খরচও আছে। শরণার্থীদের ট্রেন ভাড়া না দিলেও চলে। কিন্তু নগর পরিবহন, ট্রাম, বাসের অফিস যাত্রী, স্থানীয় নিত্যযাত্রীরা যে ভিড়, গাদাগাদি আর ঠাসা-গ্যাঞ্জায় প্রতিদিন যাতায়াত করে, শরণার্থী একজন যদি এর মাঝে বিনেপয়সায় যাওয়ার আবদার তুলে তবে পাবলিকই ক্ষেপে যাবে। কলকাতার অনেক বেকার ট্রামে বাসে উঠলেই নকশাল বনে যেতে বসেছি। ভাড়া না দেওয়ার পদ্ধতি অনেকের অনেক রকম। কনডাক্টর ভাড়া চাইলে মাথা নাড়িয়ে সরাসরি বলে দেয়Ñ না, দেব না। কনডাক্টর আড়চোখে পরখ করে নেয়। পকেটে পেটো, ছুরা থাকতেও পারে। মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে হাত বাড়ায়। কেউ আবার ভাড়া চাওয়ার সাথে সাথে বক্তৃতাও ঝারতে শুরু করে। আগে গভর্মেন্ট চাকরি দিক, পরে দেখা যাবে। তাত্ত্বিক নকশাল, সশস্ত্র লাইনের নয়। নরমপন্থী মনে করে কনডাক্টর আবার ঘুরে এসে হাত বাড়ায়। এবার একটু গরম ভাব। বললাম তো দেব না, কানে যায় না। নিজেতো মাসকাবারি বেতন পাচ্ছেন, তার উপর কোম্পানির টাকা লুটপাটে ভাগ বসাচ্ছেন, চেহারাতেও দেখি তেলতেলি ভাব এসেছে। গভর্মেন্ট চাকরি দিক, নয়তো বেকার ভাতা দিক। দেশের মানুষ না খেয়ে মরছে আবার এক কোটি শরণার্থী পোষার সাধ জেগেছে। শ্লা, বর্জুয়া সব নিজেরা…। কনডাক্টর দ্রুত সরে যায়। আশেপাশের মানুষও বিরক্তিতে মুখ ফেরায়। এমন গাদাগাদি ভিড়ে আর গরমে কানের কাছে লেকচার কার ভাল লাগে। ভাড়া না দিক, মুখটা বন্ধ থাক। আমিও যে সব সময় ভাড়া দেই, তা নয়। ফাঁকিও দেই। অনৈতিক চর্চায় কিছুটা অপরাধ বোধ আপনা থেকেই জেগে উঠে। সান্ত¦নার যুক্তিও তৈরি। শরণার্থী হয়ে আছি, সরকারের রেশন তো খাচ্ছি না। ক্যাম্পে থাকলে প্রতিদিন কমপক্ষে দু’টাকা আমার জন্য খরচ হতো। ট্রামে বাসে সারাদিন ঘুরলে একটাকার বেশি লাগে না। আরো একটাকা তো পাওনাই থেকে যায়। অকাট্য যুক্তি বুকের বল বাড়িয়ে দেয়। ভিড় দেখে বাসে উঠি। দরজায় ঝুলে থাকে জনা দশেক। তার মাঝে আমিও একজন। কনডাক্টর ভিতরের ভিড় ঠেলে ভাড়া নিতে দরজার কাছাকাছি আসার আগে কতজন যে কত স্টপেজে নামে আর উঠে তার হিসেব নেই। সময় একটু বেশি লাগে। একই রুটে একই গন্তব্যে দু’তিনটি বাস পাল্টাতে হয় এই আর কি। যাত্রীদের লক্ষ্য করি কে কোথায় যাবে বলে না অনেকেই। বলে একটা তের নয়া। দশ নয়া থেকে তের নয়া, পনের নয়া, আঠারো নয়া এভাবে টিকেটের রেট। কেউ মাথা নাড়িয়ে বলে হয়েগেছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কনডাক্টর সাধারণত টিকেট দেখতে চায় না। হঠাৎ কখনো যদি কনডাক্টরের মুখোমুখি হয়ে যাই মিথ্যে কথাটা বেরুতে চায় না। কপালের লিখন মেনে নিয়ে নীরবে পকেটে হাত ঢুকিয়ে তলানিতে পড়ে থাকা কয়েন বের করে বলিÑ একটা দশ নয়া। মনটা খচখচ করে। জেঠতুতো দিদির বাড়িতে খাচ্ছি দাচ্ছি থাকছি। কোনো অসুবিধা নেই। উনাদের দু’তিনটি ছেলেমেয়ের প্রতিদিন স্কুলে যাবার বাসভাড়া, টিফিন খরচ দিতে হয়। আমার এমন বিনেকাজে সারাদিন ঘোরাঘুরির জন্য পয়সা নেই কি করে। তবুও ঠানদি মাঝে মাঝে বেরুনোর সময় বিশ নয়া, ত্রিশ নয়া পকেটে পুরে দেন। অনেক মনে হয়। আর আমিতো কোনছার! মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী’র পরিবার সিরাজগঞ্জের কাজীপাড়া থানার কোনো এক গ্রামে আটকা পড়ে আছেন। তাদেরকে খুঁজে নিয়ে আসতে লোক পাঠানোর খরচ একশত টাকা মন্ত্রী মহোদয় যোগাড় করতে পারেননি সাতদিনেও। পাবনার সাংসদ আব্দুর রব কলকাতার এক বন্ধুর কাছ থেকে একশো টাকা এনে দিলে সে টাকায় মনসুর আলী’র পরিবারকে কলকাতা নিয়ে আসার ব্যবস্থা হয়। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com