1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
রবিবার, ০৪ মে ২০২৫, ১১:২৮ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরর্ণাথী ৭১

  • আপডেট সময় বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

সুখেন্দু সেন :
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত কিছু পোস্টার দু’তিন জন মিলে লাগিয়ে দিয়েছি কলেজ স্ট্রিট এলাকায়। মুজিবনগর সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের পক্ষ থেকে অনেক ধরনের পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। এবারের সংগ্রাম/ স্বাধীনতার সংগ্রাম, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব / ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল; বাংলার মায়ের- বাংলার মেয়েরা/ সকলেই মুক্তিযোদ্ধা; বাংলার হিন্দু/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার খ্রিস্টান/ বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালি। ইয়াহিয়ার বিকৃত মুখাকৃতি চিত্রিত পোস্টারÑ ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ চোখে পড়ে সর্বত্রই। ছাত্র সংগ্রাম সমিতির অফিসে তখন খোঁজ-খবর নিতে আগন্তুকদের সংখ্যা কমে গেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতারা অনেকেই তখন প্রকাশ্যে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন, সভা-সমিতিতে যোগ দিচ্ছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতির কার্যপরিধির অনেক বিস্তৃতি ঘটেছে এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মাঝে প্রায় দুই শত বিদেশি সংস্থা যারা বাংলাদেশের সমর্থনে কাজ করছে তাদের সাথে সমিতি সংযোগ রক্ষা করে চলছে। বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শরণার্থী শিবির সীমান্ত এলাকা ঘুরে সমিতির কার্যালয়ে এসেও নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন।
প্রতিদিন একবার করে দ্বারভাঙ্গা হলে এসে ঘুরে যাই। তেমন কিছু করার নেই। এর মাঝে ছাত্রসহায়ক সমিতির উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়ে গেছে। ‘ব্লিডিং বাংলাদেশ’ নামক এই প্রদশর্নীর উদ্বোধন করেন উপাচার্য ড. সত্যেন সেন। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর পৈশাচিকতা, হত্যাকা- ও নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে প্রদর্শিত ছবিগুলিতে। দর্শক এবং স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে চার-পাঁচ দিন বেশ ভালোই কাটলো। সকাল থেকে ঘোরাঘুরি শুরু হয়ে যায়। আজ স্বীকৃতির দাবিতে, কাল বঙ্গবন্ধুর বিচার বন্ধের দাবিতে, পরশু পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের প্রতিবাদে মিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, সমাবেশ লেগেই আছে। উদ্যোক্তা যেই হোক ডান-বামের বালাই নেই। যোগ দেয়া চাই। হাজরা পার্ক, সুবোধ মল্লিক স্কয়ার, কলেজ স্কয়ারে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সাংস্কৃতিক সংস্থার অনুষ্ঠান। দেশাত্মবোধক গান, বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙানো, মাইকে ৭ই মার্চের ভাষণ। স্থানীয় লোকজন, পথচারী, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শরণার্থীরা এসে ভিড় করে। বাংলাদেশের হাই কমিশনার হোসেন আলীকে মাঝে মাঝে দেখা যায় এ ধরনের অনুষ্ঠানে। চেয়ার-টেবিলের বালাই নেই, মাটিতে বসেই প্রধান অতিথি হোসেন আলী। আমার ধারণায় একেবারে মাটির মানুষ। সাধারণ বেশভুষা, চেহারা চাহনিতেও এক ধরনের সারল্য। পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের পেশাদার কূটনীতিক হলেও মনে সম্ভবত আমলাতন্ত্র বাসা বাঁধেনি। কেমন যেন একটা আস্থা জন্মে উনাকে দেখলে। সভাপতির বসার ব্যবস্থাও একই। ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয় গলির মোড়ে, কখনো রাজপথে। বড় অনুষ্ঠানও আছে। ক’দিন আগে জোড়াবাগান পার্কে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান হল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। স্থানীয় যুব কংগ্রেসীদের অভিনীত ‘জয় বাংলার মুক্তিফৌজ’ নাটক। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির উদ্যোগে বিদ্রোহী বাংলা, পৃথিবীর কণ্ঠস্বর নাটিকা, বাংলাদেশ ও রবীন্দ্রনাথ শীর্ষক গীতিকবিতা প্রদর্শিত হয়েছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে পোস্টার ছাপিয়ে প্রচারণাও হয়েছিল। উত্তর কলকাতার নকশাল প্রভাবিত এলাকা, ঝুঁকিপূর্ণ। পোস্টারে বাংলাদেশের অতিথির নাম দেয়া হতো না। মেয়র শ্যামসুন্দর গুপ্ত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন। মন্ত্রী অজিত পাজা, বাংলাদেশে অজয় দাসগুপ্ত, বজলুর রহমান, মুজিবনগর সরকারের সচিব নূরুল কাদের উপস্থিত ছিলেন। আমার মতো অনেকের দেখা পাওয়া যায় সেসব অনুষ্ঠানে শ্রোতা-দর্শক হিসেবে। তবে বেশির ভাগই খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল অঞ্চলের। সিলেটি খুব একটা পাওয়া যায় না। তাতে কী, সকলেরই এক পরিচয় জয়বাংলার লোক। সমগোত্রীয়, অল্পেই ভাব হয়ে যায়। কেউ সাগ্রহে ব্যক্ত করেন সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা, দেন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। ঘর-বাড়ি পুড়ে যাওয়া, পাঞ্জাবির আক্রমণে বিপর্যস্ত হওয়া, পথে পথে দুর্ভোগ, রাজাকারের হাতে নিগৃহীত হওয়ার কাহিনী। আপনজন হারানোর সদ্যস্মৃতির কষ্ট ভাগাভাগি করে নেয়া। কারো কারো ইতিহাস বড়ো করুণ, মর্মান্তিক। তবুও বাঁচতে হবে, স্বাধীনতার জন্য দিন গুনতে হবে।
কারো কারো কাছ থেকে জানা যায়, আগামীতে কোথায় কি হবে। এমনি এক খবরÑ শরণার্থী ফুটবলাররা স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম গঠন করেছে। আগামী মঙ্গলবার মোহনবাগান দলের সাথে, ময়দানের মোহনবাগান মাঠে ফুটবল খেলবে বাংলাদেশ দল। ফুটবল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ। হবেই না কেন? শিল্পীরাও তো গান গেয়ে যুদ্ধ করছেন। কবিরা লিখছে যুদ্ধের কবিতা। চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকছে। সবাই যে যার অবস্থানে থেকে সাধ্যমত স্বাধীনতার জন্য কিছু একটা করে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত হলো ময়দানে খেলা দেখতে যাওয়ার। ঐক্যমত হলেও কেউ কেউ হয়তো যাবে ঠিকই কিন্তু আর কখনো কারো সঙ্গে যে আবার দেখা হবে সে নিশ্চয়তা নেই। নতুন নতুন পরিচয় ঘটে, আবার যে যার মতো হারিয়ে যায়।
কলকাতায় ঘোরতর বর্ষা। অন্যবারের তুলনায় এবার যেন একটু বেশি। শরণার্থী শিবিরে দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে বর্ষার জলকাদা। ছড়াচ্ছে রোগ। কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তবু বর্ষা কাক্সিক্ষত সবার কাছেই। বাংলাদেশের নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-মাঠ-ঘাট ভাসবে বানের জলে। ডুবে মরবে পাঞ্জাবিরা। মঙ্গলবার সকাল থেকেই বৃষ্টি। দুপুরের দিকে আকাশ ভেঙে নামছে। কোনো জায়গায় ট্রাম লাইন বন্ধ হয়ে আছে। ছাতা নেই। ট্রাম থেকে নেমে হেঁটেই ছুটছি ময়দানের দিকে। এমন বর্ষণের মাঝেই হাজার হাজার মানুষ। কেউ বলেন লক্ষ হতে পারে। খেলা শুরু হল। মোহনবাগান খেলছে গোষ্ঠপাল একাদশ নামে। আর বাংলাদেশ দলের যে নামই থাক পরিচয় জয় বাংলার দল। ঝড়-বৃষ্টি ছাপিয়ে জয় বাংলা ধ্বনি উঠছে ময়দানজুড়ে। তবে হেরে গেল বাংলাদেশ দল ৪-২ গোলে। ভালোই খেলছে জাকারিয়া পিন্টুর দল। মন খারাপের কিছু নেই। জয় বাংলার গর্জন তো ছড়িয়ে পড়লো সারা কলকাতায়। শুনলো বিশ্ববাসী। ভিজে জবুথবু হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরতে বেশ রাত।
এর আগে নদীয়ায় প্রথম ম্যাচ তো অন্যন্য এক ইতিহাস সৃষ্টি করে রইলো। নদীয়া জেলা একাদশের সাথে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলা হয়েছিল ২৪ জুলাই। সবেমাত্র দল গঠন হয়েছে। দলে আছেন জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ হাজরা, কাজি সালাউদ্দিনসহ অনেক জনপ্রিয় ফুটবলার। স্টেডিয়ামে ভারতীয় পতাকার সাথে সমান গৌরবে উড়বে সবুজ পটে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালী মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। জেলা স্টেডিয়ামে উপচে পড়ছে দর্শক। ক্যাম্প ছেড়ে আসছে শরণার্থী, সীমান্ত অতিক্রম করে কুষ্টিয়া থেকে ছুটে আসছে স্বাধীনতাকাক্সিক্ষ মানুষ। শুধু কী খেলা দেখার জন্য। আজ যে ইতিহাস সৃষ্টি হবে। একটি স্বাধীন দেশের পতাকার পাশাপাশি উড়বে রক্তমাখা গৌরবের স্বাধীন বাংলার পতাকা। প্রথমবারের মতো এমন পবিত্র দৃশ্যটি না দেখে থাকা যায়? কিন্তু খেলা শুরুর আগে বাদ সাধলেন নদীয়ার ডিসি। ভারত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশকে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আগে জেলা প্রশাসক কিভাবে অনুমতি দেবেন আরেকটি দেশের পতাকা উড়ানো। কিন্তু দর্শকরা তা মানতে নারাজ। প্রতিবাদ, চিৎকার, হৈচৈ। কিভাবে সামাল দেয়া যায় এই দর্শকদের। ভাঙচুরও শুরু হল। নিরুপায় ডিসি সাহেব এবার ঝুঁকি নিলেন। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে তবে দশ মিনিটের জন্য। সেই উত্তেজনাকর ঐতিহাসিক মুহূর্ত। উঠলো বাংলাদেশের পতাকা, লাল-সবুজ আর সোনালী মানচিত্রের প্রাণের পতাকা। আবেগ আপ্লুত খেলোয়াড়েরা গাইলেনÑ আমার সোনার বাংলা…। জয় বাংলার তুর্যনিনাদ যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। নব্বই মিনিট জুড়েই গগনবিদারী জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা। খেলা শেষ হলো ২-২ ড্র তে। কিন্তু জয় বাংলা ঢেউ ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে আছড়ে পড়লো পাকিস্তানের হৃদপিন্ড করাচিতেও। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলি নয়, হৃদপি- ঝাঁজরা করে দিতে পারে ফুটবলও, সেটি এবার বুঝা গেল। আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানালো পাকিস্তান ফিফা’র কাছে। যাতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সাথে কোনো খেলার আয়োজন না করে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন। ফিফা’র আইনের বাধ্যবাধকতায় তাই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব মোহনবাগান খেলেছিল গোষ্ঠপাল একাদশ নামে। অন্য দলগুলিও একই কৌশলে নাম বদলিয়ে খেলে পরবর্তীতে। আর স্বাধীন বাংলা দল বাংলাদেশ ইলেভেন নামে। আর এদিকে, নদীয়ার ডিসি ডি.কে. ঘোষ সাময়িক বরখাস্ত, সঙ্গে নদীয়া জেলা ক্রীড়াসংস্থাও। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com