সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বর্ষা ঘনিয়ে এলে শরণার্থী শিবিরে বেড়ে যায় দুর্ভোগ। কলেরা, আমাশয়, রক্ত আমশয়, গ্যাস্ট্রো এনটাইটিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ছড়ায় আতঙ্ক। ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য পরিবহনে সংকট। এমনিতেই ত্রিপুরার যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক। কলকাতার সাথে বিমান ব্যতীত অন্য পথগুলি আসাম মেঘালয়ের দুর্গম পাহাড় ডিঙিয়ে। বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের উপর দিয়ে উড্ডয়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আকাশ পথেও সময় বেড়েছে প্রায় তিন ঘণ্টা। আগরতলা শহর থেকে কাছাকাছি রেলস্টেশনের দূরত্ব ২১০ কিলোমিটার। স্বাভাবিকভাবেই আকাশপথে পরিবহন ব্যয়বহুল এবং স্থলপথে সময়সাপেক্ষ। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বিভিন্ন শিবির ঘুরে বিতরণ করেন ত্রাণসামগ্রী। আশ্বস্ত করেন শরণার্থীদের। আশ্বাস দেন প্রতিকারের। সেই সাথে চলছে বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা। বেড়ে যায় গুপ্তচরদের আনাগোনা। রাস্তায় পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে গেছে ত্রাণবাহী ট্রাক। ৫০ জনের মতো ধরা পড়েছে। শরণার্থীর ছদ্মবেশে আরো কতো গুপ্তচর এবং নাশকতাকারী রয়েছে তা শনাক্ত করা কঠিন। সীমান্তজুড়ে পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ভারতীয় গ্রাম এমনকি শহরও। রক্ষা পাচ্ছে না শরণার্থী শিবির। ১৪ আগস্ট বারমুটিয়ায় জলিলপুর শরণার্থী শিবিরে ঢুকে পাকবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই ১৩ জন শরণার্থী প্রাণ হারায়। গুরুতর আহত হয় ৯ জন। পাকিস্তানি গোলা ও মর্টার শেলের আঘাতে বিশালগড়, বক্সনগর, পুরান রাজবাড়ি, উত্তর রাঙামোড়া, কলমচূড়া, সোনামুড়া, কাতলামাড়া, কমলপুর, কেনাবর, সাব্রুম, ঈশানপুর, গঙ্গানগর শরণার্থী শিবিরে এ পর্যন্ত ৮৪ জন নারী-পুরুষ-শিশু এবং ৬৭ জন ভারতীয় নাগরিক প্রাণ হারায়। ২শ জন শরণার্থী ও ২৩৫ জন ভারতীয় নাগরিক গুরুতর আহত। সীমান্ত শহর বেলুনিয়া পাকিস্তানি গোলায় বিরাণ। আশেপাশের গ্রাম ও শহর ছেড়ে কয়েক হাজার মানুষ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। গৃহচ্যুত পরিবারগুলির জন্য নতুন করে ১০টি অস্থায়ী শিবির খোলা হয়। সেখানেও চলছে ত্রাণ কার্যক্রম। বিপর্যস্ত সোনামুড়া শহরের জনজীবন। মহকুমা শহরটির সরকারি কাজকর্মও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। স্থানীয় লোকজন শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। নিজের বাংলোতে বাংকার বানিয়ে অফিস করেন সোনামুড়ার এসডিও। আগরতলার বনমালিপুর ও শিবনগর মসজিদ রোডে মর্টারশেলের আঘাতে নিহত হন রাজ্য সরকারের একজন কর্মচারী, দুইজন গৃহবধূ ও এক শিশু।
রাজ্যের ৭৫ ভাগ এলাকাজুড়ে রণাঙ্গন। সর্বত্রই যুদ্ধের ঘনঘটা। মাঝে মাঝে বিমান আক্রমণের পূর্বাভাসে বেজে উঠে বিকট সাইরেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, আতঙ্কে শহরের লোকজনের ছোটাছুটি। এমন ডামাডোলের মাঝেই চলছে সভা সমিতি মিছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শরণার্থী শিবির, যুদ্ধ শিবির, প্রশিক্ষণ শিবিরেও ছড়ায় সুরের ঝঙ্কার। মনোবল জিইয়ে রাখতে উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে যায় শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা। পাকিস্তানি অসুর বাহিনীর বিনাশ কামনায় শিবিরে শিবিরে দেবী দুর্গার আবাহন। শবে-বরাতের রাতে প্রশিক্ষণ শিবিরে জুটে মিষ্টি ও উন্নত খাবার। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে এবারের বিশেষ আয়োজন বাংলাদেশ বন্দনা। রকমারি অনুষ্ঠানে যোগদেন স্থানীয় ও শরণার্থী শিল্পী, বরেণ্য কবি সাহিত্যিকরা। নজরুল জয়ন্তীতে কবির সংগ্রামী গানে গানে মুখর আগরতলা। কবির আত্মীয়া কবরী গুপ্তার উপস্থিতিতে মূল অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শিল্পী সংস্থার ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের ছন্দময় নৃত্যরূপে দর্শকরা উজ্জীবিত হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
২ আগস্ট ত্রিপুরার ছাত্রছাত্রীরা পালন করে বাংলাদেশ দিবস। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে এদিন অনুষ্ঠিত হয় মিছিল-সমাবেশ। আগরতলা ও শহরতলি এলাকার সকল স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ‘রোশনআরা দিবস’ পালনে বের করে বিরাট মিছিল। মিছিল শেষে শিশু উদ্যানে সমাবেশ। রোকেয়া হলের ১৭ বছরের অসম সাহসী ছাত্রী বুকে মাইন বেঁধে ট্যাঙ্কের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১৯ জন পাকসেনা খতম করার কাহিনী প্রথম প্রচারিত হয় আগরতলা থেকে। দৈনিক সংবাদের রিপোর্ট এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরের মাধ্যমে। রোশনআরা নামটি ঠিক করে দেন শরণার্থী হয়ে আশ্রিত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। রোশনআরা এক প্রতীক সাহসিকা হয়ে উঠে রাতারাতি।
১৫ আগস্ট ছেচুরিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং স্থানীয় জনগণ মিলিতভাবে উদ্যাপন করে ভারতের স্বাধীনতা দিবস। বিভিন্ন ব্লকের শরণার্থীরা স্বাধীন বাংলার পতাকা এবং স্থানীয়রা ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে ব্যান্ডপার্টি সহযোগে মিছিল করে সমবেত হয় রিলিফ অফিসের সামনে। এর আগে এখানে কখনো এমন জমকালো স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়নি।
শরণার্থী শিবির, মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে, আগরতলার মোড়ে মোড়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, রাজনৈতিক নেতা, যুবনেতারা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে তরুণ যুবকদের মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করছেন। শিল্পীরা গায় দেশাত্মবোধক গান। ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে পোস্ট অফিস চৌমোহনীতে মতিয়া চৌধুরী একটানা দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করে শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখেন। সূর্যমণি নগরে স্থানীয় শিল্পীরা আয়োজন করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বাংলাদেশ শিল্পী সংস্থার শিল্পীরাও যোগ দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতা আব্দুল কদ্দুস মাখন প্রধান অতিথি হিসেবে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে উজ্জীবিত করেন শ্রোতাদের। একদিকে সভা, সমাবেশ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান; অন্যদিকে ত্রিপুরার শহরে শহরে চলছে অসামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া। বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবরে আগরতলায় শুরু হয়ে যায় আনন্দ উৎসব। শরণার্থী শিবির থেকেও জয় বাংলা বলে বেরিয়ে আসে শরণার্থীরা। মানুষ ছুটে যেতে চায় মুক্তাঞ্চলে।
আগস্টের প্রথমদিকে ইন্দিরা গান্ধী আবার এলেন আগরতলায়। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে যথারীতি বৈঠক আলাপ-আলোচনা করলেন। ঘুরে দেখেন শরণার্থী শিবিরও। পুরান রাজবাড়ি, হাফানিয়া শিবিরে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে সংক্ষেপে দু’চার কথা বললেন শরণার্থীদের সামনে। তবে এবার আরেকটু এগিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। হাজির হলেন মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে। স্বচক্ষে দেখলেন লুঙ্গি, গেঞ্জি পরিহিত মুক্তিফৌজদের। দেখলেন তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ক্যাম্পে ফৌজি ফৌজি ভাব থাকায় কোনো ভূমিকা না দিয়ে তিনি হিন্দিতেই বলতে শুরু করলেনÑ মুক্তিফৌজ ভাইলোগ, আপলোগোকে তাকলিফ হাম দেখরাহে, খানেকা বর্তন নেহি হ্যায়। শোনেকেলিয়ে সাফিসিয়েন্টে কম্বল, তাকিয়া নেহি হ্যায়। লেকিন ক্যায়া করু। হামারি মজবুরি বহুতি হ্যায়। …।
না না ম্যাডাম, অস্ত্র চাই। ভাত খাওয়ার বর্তন নয়। আমাদেরকে সাফিসিয়েন্ট অস্ত্র দিন। আর কিচ্ছু চাই না। তরুণ যোদ্ধাদের এমন আবেগ উচ্ছ্বাসে ইন্দিরাজি একটু থমকে গেলেও বিমোহিত হলেন, মুক্তির আকাক্সক্ষায় টগবগে এই তরুণদের বেশভুষা শুষ্ক মলীন চেহারা, উষ্ককুষ্ক চুল সবকিছুকে পেছনে ফেলে চোখেমুখে দেশপ্রেমের এক অদ্ভুত দীপ্তি যেন টিকরে বের হচ্ছে। ওরা খাবার চায় না, ভালোভাবে ঘুমাতে চায় না, দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে ওরা অস্ত্র চায়। যুদ্ধ করে মরতে চায়। এমন প্রতিজ্ঞা যেখানে দৃঢ় হয়ে আছে, সে দেশ কি মুক্ত না হয়ে পারে?
আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ম্যায়নে ওয়াদা করতি হুঁ। আপ লোগোকো হারতারেকা মদদ করনেক্যা কুশিস ম্যায় করুঙ্গি। …।
এবার স্লোগান উঠলো জয় বাংলা, জয় ভারত। (চলবে)