1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ০৮:৫৪ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরর্ণাথী ৭১

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬

সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বানের জলের মতো শরণার্থীর ¯্রােত সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে ত্রিপুরায়। শরণার্থী প্রবাহের সাথে খাদ্য ও রিলিফ প্রবাহ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন শরণার্থী। অন্যদিকে পাকবাহিনীর গোলাগুলিতে সীমান্ত এলাকা বিপর্যস্ত। বিশালগড় থেকে স্থানীয় লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে সরে যাচ্ছে। ৯ মে সোনামুড়া সীমান্তের দুর্গাপুর গ্রামে পাকিস্তানি গোলায় ৯ জন হতাহত। সরকারি তহশিল অফিসের উপর কামানের গোলা আছড়ে পড়ে। ১২ মে সাব্রুম সীমান্তে মর্টারশেলে আঘাতে নিহত ৩ ভারতীয় নাগরিক। আহত ৮০ জন। এর আগে ছোটখিল এলাকায় পাকিস্তানি হানায় তিনটি সীমান্ত গ্রাম পুড়ে ছাই। আখাউড়ায় পাকবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণ ও মুহুর্মুহু গোলার শব্দে কাঁপছে আগরতলার মাটি। ১৪ মে আগরতলার উপকণ্ঠে নিহত ২, আহত ১৯ জন ভারতীয়। এমন ঘনঘটার মধ্যেই ১৫ মে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসলেন আগরতলায়। সঙ্গে কেন্দ্র্রীয় মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়, সরোজিনী নাইডুর কন্যা ভারতীয় রেডক্রসের চেয়ারম্যান পদ্মজা নাইডু। শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য নিয়ে যাওয়া হল মোহনপুর ক্যাম্পে। বিমানবন্দরের কাছাকাছি এ ক্যাম্পটি পরিপাটি ও সুশৃঙ্খল। প্রধানমন্ত্রী বললেনÑ কই, এরা তো কষ্টে নেই। তিনি অন্য ক্যাম্পেও যেতে চান। ঈশানপুর ক্যাম্প সীমান্ত এলাকায়। নিরাপত্তা বাহিনী যাওয়ার ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে না। তাদের নিষেধের তোয়াক্কা না করেই প্রধানমন্ত্রী ছুটলেন ঈশানপুরে। দেখলেন শরণার্থীদের দুরবস্থা। কাছাকাছি গিয়ে অন্তর দিয়ে অনুভব করলেন অসহায় মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনা। রেশন এবং সাহায্য সহযোগিতা বাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে বিষণœ মনে ফিরে এলেন। অর্ধভুক্ত, অভুক্তদের সাথে সহমর্মিতাই হোক আর ব্যস্ততার জন্যই হোক সারাদিন প্রধানমন্ত্রীর খাওয়া হল না। কেবল চা খেয়েই কাটিয়ে দিলেন। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ইন্দিরা বলেনÑ এ সমস্যা শুধু রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক নয়। এর গভীরতা আরো ব্যাপক। শরণার্থী সমস্যার কারণে ভারত এর সাথে জড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন অভিযোগ ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেনÑ নতুন করে সমস্যার কথা জানতে আসিনি। এসেছি লাঞ্ছিতদের সমবেদনা জানাতে, তাদের সঙ্গ পেতে। প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেনÑ সব শরণার্থীকে এখানে রাখা হবে না। অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে। তাদের জন্য সম্ভব সবকিছুই করবো। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি সযতেœ এড়িয়ে গেলেন। কিছুদিন পর ইউএস এয়ার ফোর্সের পরিবহন বিমানে কয়েক হাজার শরণার্থী সরিয়ে নেয়া হল অন্য রাজ্যে। ১৯ মে ধর্মনগর থেকে সাব্রুম পর্যন্ত উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার শরণার্থী এসে ঢুকছে ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে।
জাতিসংঘ উদ্বাস্তু কমিশনের তিনজন প্রতিনিধি আসেন আগরতলায়। পৃথকভাবে আসেন বিশ্বখাদ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং রেডক্রসের প্রতিনিধিরা। বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে প্রত্যক্ষ করেন তাদের দুরবস্থা। কথা বলেন শরণার্থীদের সঙ্গে। ঘরবাড়ি সহায়-সম্পদ ছেড়ে তাদের চলে আসার বাস্তবতা উপলব্ধি করেন এবং এর সত্যতার প্রমাণ মিলে সীমান্তে পাক আক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনায়। গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতা ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবিরগুলো এক সপ্তাহকাল ঘুরে দেখে আগরতলায় বলেনÑ শরণার্থী সমস্যার বেশি চাপ পড়েছে ত্রিপুরায়। তিনি আবেদন জানানÑ আসুন ত্রিপুরার পাশে দাঁড়াই। শরণার্থী পুনর্বাসনে রাজ্য সরকারকে সহযোগিতার জন্য তিনি কেন্দ্রের কাছে আহ্বান জানান।
সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম আসেন ত্রিপুরায়। শ্রীহট্ট জকিগঞ্জের সন্তান প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ড. ত্রিগুনা সেন বিপুল পরিমাণ রিলিফসামগ্রী নিয়ে কয়েকবার এসেছেন এখানে। তিনি ছিলেন মূলত বাংলাদেশ সহায়তা বিষয়ক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ইনফরমাল কমিটির সমন্বয়ক। মার্কিন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি, ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সাবেক লর্ড গ্রিগ শিবিরে ঘুরে ঘুরে শরণার্থীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। মধুপুর শিবিরে শরণার্থীদের কাছে পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের ঘটনা শুনে গ্রিগের চোখে অশ্রুধারা বয়ে যায়। শরণার্থী এক মহিলা গ্রিগকে জানানÑ তার তিন ছেলে যুদ্ধে গেছে। তারা যদি লড়াই করতে করতে মরেও যায় দুঃখ নেই। নাতিরা বাস করবে স্বাধীন দেশে। অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি শরণার্থীদের সাথে কথা বলেন একান্তে। সার্কিট হাউসে শরণার্থী বুদ্ধিজীবীদের সাথেও বৈঠক করেন তিনি। ইতালির পার্লামেন্ট সদস্য ড. এন্টিলেনো, ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের চার সদস্যের দলও আগরতলায় এসে শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেন। দলের সদস্য লেবাননের বিশিষ্ট আইনজীবী মাহোমোদ টেব্বো বলেনÑ প্যালেস্টাইন শরণার্থীদের সাথে পূর্ববাংলার ছিন্নমূল মানুষের কথা সহজেই মনে আসে।
মার্চের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আগরতলার পত্র-পত্রিকাগুলি গুরুত্বের সাথে সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। যা অব্যাহত থাকে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত। সংবাদপত্রগুলি শুধু সংবাদ পরিবেশন করেই ক্ষান্ত হয়নি, দৈনিক সংবাদ সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক এবং পিটিআই যুগান্তর প্রতিনিধি ও সাপ্তাহিক সমাচার সম্পাদক অনীল ভট্টাচার্য্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। আগরতলার পত্র-পত্রিকা দেখলে ভিন দেশের ভিন রাজ্যের বলে মনে হতো না। মনে হত এগুলি স্বাধীনতাকামী বাঙালি, অসহায় শরণার্থীদের মুখপত্র। শিরোনাম, প্রথম পাতার খবর, সম্পাদকীয়তে প্রাধান্য পেত পূর্ব বাংলা, বাংলাদেশ। দৈনিক সংবাদ, দৈনিক গণরাজ, দৈনিক রুদ্রবীণা, দৈনিক জাগরণ, সাপ্তাহিক সমাচার, দেশের কথা, সীমান্ত প্রকাশ-এ নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের টাটকা খবর শরণার্থী শিবির, শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশা, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম প্রভৃতি সংবাদে সরগরম। শরণার্থী বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকেরাও প্রকাশ করেন অর্ধ সাপ্তাহিক জয় বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, বাংলার মুখ, স্বাধীনতা প্রভৃতি পত্রিকা। আগরতলা থেকে প্রকাশিত হলেও প্রিন্টার্স লাইনে লেখা থাকতো মুজিবনগর। অর্ধ সাপ্তাহিক জয় বাংলা পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায় প্রবাসী সরকারের নির্দেশে। তখন মুজিবনগর থেকে জয় বাংলা নামে সরকারের মুখপত্র হিসেবে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। আকাশবাণী আগরতলা কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে উদ্দীপনামূলক দেশাত্মবোধক গান সম্প্রচারের নির্দিষ্ট সূচি ও সময় বাড়িয়ে দেয়। জাতি ধর্ম বাঙালি উপজাতি আদিবাসী ত্রিপুরি রিয়াং জমাতিয়া নোয়াতিয়া রুপিনি মোরসিং উচোই প্রভৃতি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এগিয়ে আসে শরণার্থীদের সহায়তায়। যে যেভাবে পারে আশ্রয় দিয়েছে, সমর্থন জানিয়েছে মুক্তিসংগ্রামের প্রতি। পাকিস্তানি সেনাদের বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞে উদ্বিগ্ন হন ত্রিপুরা রাজ্যবাসী।
২৯ মার্চ ত্রিপুরা বিধান সভা অধিবেশনে মিলিত হয়ে গণহত্যার তীব্র নিন্দা ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানায়। মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের নেতৃত্বে ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, এমএনএ, পদস্থ কর্মকর্তা, বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক নাগরিক পরিষদ’। ২৮ মার্চ আগরতলায় এক ছাত্র সমাবেশে পূর্ববাংলা ছাত্র সংগ্রাম সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি সজল লস্কর, সম্পাদক রাখাল দত্ত। সিপিএম-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সংহতি কমিটি। তাদের পরিচালিত ক্যাম্পগুলির নাম ছিলÑ পিপল রিলিফ ক্যাম্প। স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম সহায়ক পরিষদের সভাপতি ছিলেন ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা ব্রজগোপাল রায়। বাংলাদেশ উদ্বাস্তু ত্রাণ মহিলা কমিটি, স্বাধীন বাংলা সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি, নিখিল ত্রিপুরা শিক্ষক সমিতি, সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন, ছাত্র পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি সংগঠন শরণার্থীদের সহায়তা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসে। ক্রমাগত শরণার্থীর চাপে জনপ্রশাসন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলে রাজ্য সরকার নতুন উদ্বাস্তু ত্রাণ অধিদপ্তর খোলে। প্রতিষ্ঠা করতে হয় স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন। বিশালগড় সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে শরণার্থীরা জড়ো হলে স্থানীয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে দেয়। সাধারণ শরণার্থীর সাথে কয়েকজন পুলিশ ও ইপিআর এখানে এসে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল। প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ টুকু মিয়াকে সভাপতি এবং হরিপদ ভট্টাচার্য্যকে সম্পাদক করে স্থানীয়ভাবে গঠিত হয় বিশালগড় কড়ইমুড়া শরণার্থী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ কমিটি। সোনামুড়ায় গঠিত হয় নাগরিক কমিটি সোনামুড়া। পূর্ববাংলা থেকে আগত শরণার্থী শিক্ষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ, শরণার্থী সাংস্কৃতিক কর্মীরা গড়েন বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা। ছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয় এবং কার্যক্রম। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com