সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আওয়ামী লীগ নেতা সাংসদ রাজনীতিকদের অবস্থান ফরেস্ট বাংলো, এমএনএ হোস্টেল, শ্রীধর ভিলা, সুনন্দা ভট্টাচার্যের সরকারি আবাসনে। ডা. সুজিত দেবের সরকারি আবাসনে কয়েকজন সামরিক নেতার থাকার ব্যবস্থা হয়। বামপন্থী নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবীদের আশ্রয়স্থল ক্র্যাফটস্ হোস্টেলে। অনেকের পরিবারও রয়েছে এখানে। ভাসানী ন্যাপের নেতৃবৃন্দ শ্রমিক ও বামপন্থী নেতারা সিপিএম নেতা ভানু ঘোষ এবং খগেন দাসের রামনগরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বনমালিপুরে ডা. নন্দলাল চক্রবর্তী এবং জজ এসএম আলী অনেকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। শহরতলির পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকদের আস্তানা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ডিসি এইচটি ইমাম, হবিগঞ্জের এসডিও আকবর আলী খান, কিশোরগঞ্জের এসডিও খসরুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও কাজী রকিব উদ্দিনসহ অনেক আমলারা তখন আগরতলায়। আমলারা থাকতেন এয়ারপোর্ট রোডের চক্রবর্তী বাবুর বাগানবাড়িতে। এমবিবি কলেজের হোস্টেলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতাদের অবস্থান। কলেজের নির্মাণাধীন বিজ্ঞান ভবনে শরণার্থী শিল্পী – সাংস্কৃতিক কর্মীদের ক্যাম্প। অজিত রায়সহ অনেকেই এখানে আছেন। সকাল-সন্ধ্যা রিহার্সেল করেন শিল্পীরা। সপরিবারে থাকতেন মেজর মীর শওকত আলী, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এসএ ভূইয়া। মেজর খালেদ মোশাররফের স্ত্রী-সন্তান পরবর্তীতে আগরতলা এসে পৌঁছেন।
রাজনৈতিক নেতাদের অনেক পরিবার বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়েও রয়েছেন। ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ সপরিবারে থাকতেন কলেজ টিলার কাছে এক বাংলোয়। বাংলাদেশ সরকারের অফিস আছে তিনটি। কৃষ্ণনগর, শ্যামনগর ও কর্নেল চৌমোহনীতে।
যুগান্তর ও পিটিআই প্রতিনিধি সাপ্তাহিক সমাচার সম্পাদক অনীল ভট্টাচার্য্যরে বাড়ি আর লঙ্গরখানায় কোনো তফাত নেই। অঘোষিত লিয়াজোঁ অফিসও এটি। এতো এতো রাজনৈতিক নেতা সামরিক নেতাদের আনাগোনার মাঝে একদিন গুজব রটে যায়, বঙ্গবন্ধু আগরতলায় এসে পৌঁছেছেন। মানুষজন ছুটতে থাকে এদিক-সেদিক। শেষে মেলার মাঠে এসে জড়ো হয়। লোকে লোকারণ্য ভিড় সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। পুলিশ কর্তৃপক্ষও হতভম্ব। তারাও হন্যে হয়ে খোঁজতে থাকে বঙ্গবন্ধুকে।
চিত্রনায়িকা কবরী স্বামী সন্তানসহ তিনদিন না খেয়ে আগরতলার এক হোটেলে অবস্থান করছেন। সঙ্গে টাকা-পয়সা না থাকায় হোটেল ভাড়াও মিটাতে পারছেন না। পরিচয় প্রকাশ পেয়ে গেলে লোকজন এসে ভিড় করে। হোটেল কর্তৃপক্ষ পড়েন আরেক ঝামেলায়। আওয়ামী লীগের এক নেতা কবরীকে নিয়ে আসেন অনীল ভট্টাচার্য্যরে বাড়িতে। স্ত্রী গৌরী ভট্টাচার্য্যরে তত্ত্বাবধানে কবরীর পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হল। বামপন্থী শিক্ষক নেত্রী অনুপমা দাসও অনেক রাজনৈতিক নেতার পরিবারের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
কয়েকদিন হেঁেট এক কাপড়ে আগরতলা পৌঁছেন জহুরা তাজউদ্দিন। কাপড়ে গন্ধ ধরে গিয়েছিল। ক্লান্তি শ্রান্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। গৌরী ভট্টাচার্য্য নতুন কাপড় কিনে দেন। কয়েকদিনের শুশ্রƒষায় সুস্থ হয়ে লেগে যান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে। পরে কলকাতায় চলে যান তিনি।
চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম পাঠক আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নানের স্ত্রী বিলকিস বেগম অন্তঃসত্ত্বা মহিলা তবুও ছুটছেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নিজের বাড়ি থেকে পূর্ব মাদারবাড়ি, ফটিকছড়ির লালপুর, মির্জাবাড়ি, বক্তারপুর। নিজের ভার আর বহন করতে পারছেন না। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই প্রসব করেন এক কন্যা সন্তান। নবজাতিকাকে নিয়ে ভারত অভিমুখী বিভিন্ন দলের সাথে মিশে উপজাতীয় গাইডের সহায়তায় রামগড় হয়ে পৌঁছেন আগরতলা।
একদিনের এক হৃদয়বিদারক ঘটনায় শোকে বিহ্বল হয়ে যান ক্র্যাফটস্ হোস্টেলের বাসিন্দারা। ঢাকা মিউজিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ বারীণ মজুমদার এসে উঠেন ক্র্যাফটস্ হোস্টেলে। নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছেও তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছেন। মুখে কোনো কথা নেই, কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। চোখেমুখে বিষণœতা, অন্তরজুড়ে হাহুতাশ, কেবল উচাটন। দুর্ভাগ্যের কাহিনী জানাজানি হয়ে গেল। হানাদার বাহিনীর আক্রমণে পলায়নপর মানুষের মিছিলে যোগ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তিনি পরিবার নিয়ে। পেছনে তাকানোর সময় নেই। শুধু সামনের দিকে ছুটে চলা। হাজারো মানুষের সাথে হাঁটতে হাঁটতে যখন কিছুটা নিরাপদ বোধ হল তখনই পেছনে ফিরে দেখলেন তার কিশোরী মেয়েটি নেই। কেমন করে কখন কোথায় হারিয়ে গেল শতজনকে জিজ্ঞাসা করে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেও আর কোনো হদিস পেলেন না। কোন পিতা তা সহ্য করতে পারে। কন্যাশোকে তিনি স্তব্ধ।
দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড় লেগে আছে আগরতলায়। সার্কিট হাউসে স্থান সংকুলান হয় না। হোটেলেও জায়গা নেই। অগত্যা দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক আস্তানা গাড়েন আগরতলার দৈনিক সংবাদের কার্যালয়ে। এখানেই চলতো খাওয়া-দাওয়ার আর রিপোর্টিংয়ের কাজ। সাংবাদিকরা শরণার্থী শিবিরে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রণাঙ্গনে যেতেন খবর সংগ্রহের জন্য। দৈনিক সংবাদ সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক তার দপ্তরে আগত ও আশ্রিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সংবাদ সম্পর্কে ব্রিফিং দিতেন। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার তরুণ সাংবাদিক সুরজিৎ ঘোষাল এবং ইংরেজি দৈনিক অমৃতবাজারের সাব-এডিটর দীপক ব্যানার্জি সংবাদ সংগ্রহের জন্য আখাউড়া দিয়ে ঢুকে ঘুরতে ঘুরতে চলে যান কুমিল্লা পর্যন্ত। কান্দিরপাড় চৌমোহনীতে পাঞ্জাবিরা অনেক বাঙালিকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ধর্ম পরীক্ষা নিচ্ছে। সুরজিৎ ঘোষাল, দীপক ব্যানার্জিও সে লাইনে। কুমিল্লার এক নেতাও ছিলেন। জোরে জোরে কলেমা আওড়ে সে নেতাটি রক্ষা পান। দীপক ব্যানার্জি কলেমা বলতে পারলেও তাকে সন্দেহ করে আটকে রাখে। সুরজিৎ ঘোষাল পারেনি। সেই লাইনেই অন্যদের সাথে গুলি করে হত্যা করা হয় দু’জনকে।
ত্রিপুরা সীমান্তের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে যারা আশ্রয় নিচ্ছেন তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন বীভৎস্য অভিজ্ঞতা, নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন, বুলেট বেয়নেটের আঘাত।
লন্ডন টাইমস্-এর সাংবাদিক পিটার হ্যাজেনহাস্ট যখন ত্রিপুরার ছোট মহকুমা সাব্রুমে, তখন সেখানে শরণার্থীর সংখ্যা দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ এ মহকুমার মোট জনসংখ্যা ৬০ হাজার। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ৭৫ মাইল হেঁটে আসা কয়েকটি শরণার্থী পরিবারের দেখা পান। মধ্যবয়স্ক শামসুদ্দিন পরিবারের সবাইকে হারিয়ে ৩ বছরের মেয়ে রুহেনাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন। অন্যদের সাথে তিনিও সাব্রুমের পথে রওয়ানা দেন। তাদের সাথে কোন খাদ্য ও টাকা-পয়সা ছিলনা। ছয়দিন হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে মেয়েটি আর দাঁড়াতে পারছিলো না। তিনি তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকেন। কিন্তু তিনি টের পাননি কখন যে মেয়েটি তার কোলেই মারা গেছে। পথের ধারে তাকে সমাহিত করে রেখে এসেছেন। আসার পথে এরকম প্রায় শতেক নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মারা যান। তাদের অনেকের শরীরে গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল।
নিউজ উইকের টনি ক্লিফটন সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন শিবির ঘুরে রিপোর্ট পাঠান ‘টিক্কা খানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ’ শিরোনামে Ñ ত্রিপুরার একটি হাসপাতাল। সীমান্ত থেকে অর্ধেক মাইল দূরে। এই হাসপাতাল ইতোমধ্যে পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে এমন লোকদের দ্বারা পরিপূর্ণ। সেখানে চার বছরের একটি বালক আছে যার পাকস্থলি বুলেটবিদ্ধ। এক মহিলা জানাচ্ছিলো কিভাবে তার চোখের সামনেই পাকসেনারা তার দুই ছেলেকে হত্যা করেছে। এরপর তারা তাকে গুলি করে। গুলিটি তার কোলে থাকা সন্তানের নিতম্ব ছিন্ন করে তার বাম হাতে বিদ্ধ হয়। হাসপাতালের সুপারেনটেনডেন্ট আর.দত্ত জানালেনÑ কিন্তু তার জ্ঞান ছিল। তাই সে সন্তানটিকে নিয়ে সীমান্তের দিকে আসতে পেরেছে। বুলেটের আঘাতে অন্য এক মহিলার পায়ের উপরের দিকের হাঁড় বের হয়েগেছে। সে তার শিশুটিকে বাহুবন্ধনে আটকে রেখেছে। পাকিস্তানি সেনার আঘাতে সে একটি অকাল শিশুর জন্ম দেয়, তাও ধানক্ষেতে। এরপর সে তার সদ্যপ্রসূত সন্তানকে তুলে নিয়ে অন্য একজনের সাহায্যে সীমান্তে চলে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির কংগ্রেস ম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালগার যিনি আগরতলার এই হাসপাতাল পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি ভারতে এসেছিলেন এই জন্য যে, নৃশংসতার দৃশ্য বাড়িয়ে বলা হচ্ছে কিনা তা দেখতে। কিন্তু তিনি যখন নিজে আহতদের অবস্থা দেখলেন তখন তার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলো। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই সৈনিক বললেন, আমি ফ্রান্সের নরম্যানডিতে হত্যাকা-ের দৃশ্য দেখেছি। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ স্থান ছিল। কিন্তু এখানকার চেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য আমি কখনো দেখেনি। কান্নার এই দৃশ্য আমার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়েছে। (চলবে)