সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রামে কলকাতার রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রবাসী সরকারের অবস্থান, শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের কার্যক্রম অধিকাংশই ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। শরণার্থীর সংখ্যাও ছিল পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক। অবস্থানগত কারণে ত্রিপুরা রাজ্য ও রাজধানী আগরতলার গুরুত্বও কম ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক রাজধানী যদি কলকাতাকে বিবেচনা করা হয় তবে আগরতলা ছিল অলিখিত সামরিক রাজধানী বা দ্বিতীয় রাজধানী। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের মধ্যে তিনটির (১, ২, ৩) সদর দপ্তর ত্রিপুরায়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অপারেশনগুলি এই সেক্টর থেকেই পরিচালিত হয়। নিয়মিত বাহিনীর জেড ফোর্স, এস ফোর্স, কে ফোর্সেরও কেন্দ্র ছিল ত্রিপুরা। ৪, ৫ ও ১০নং সেক্টরের যোগাযোগসূত্র ছিল ত্রিপুরাÑ আগরতলা নামের সাথে বাঙালির ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক পরিচয় বিদ্যমান। এই আগরতলাকে কেন্দ্র করেই সাজানো হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। প্রধান আসামি শেখ মুজিবুর রহমান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে প্রহসনে শেখ মুজিবের ফাঁসি প্রায় নিশ্চিত। ’৬৯-এ বাঙালির আত্মজাগরণে সৃষ্ট তীব্র গণঅভ্যুত্থান সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে আয়ূবের পতন ঘটিয়ে বন্দী মুজিবকে মুক্ত করে আনে। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সামরিকজান্তা। বাঙালি অবিসংবাদিত নেতা মুজিব ঘোষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের পাহাড় অরণ্যঘেরা রাজন্যশাসিত ত্রিপুরা। মুঘল, পাঠান, ইংরাজ কর্তৃত্বের বাইরে কয়েক শতাব্দী ধরেই স্বাধীন ছিল। রাজ্যের রাজভাষাও বাংলা। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে গেলে এই ছোট রাজ্য ভারতের সাথে অঙ্গীভূত হয়। ’৪৭-এর পর পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা ব্যাপকহারে আগরতলা গিয়ে ঠাঁই নিলে আদিবাসী উপজাতিরা সংখ্যালঘু হয়ে পাহাড়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। নগরীর অধিবাসী অধিকাংশের পূর্বনিবাস চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি, সিলেট। পাঁচমিশালি বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বত্র।
আমাদের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে ত্রিপুরাবাসীর আবেগ উত্তেজনাও ছিল বেশি। মার্চ মাসের প্রথম থেকেই কোনো না কোনোভাবে তারা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে যায়। চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার দেশের সীমার বাইরে প্রথমেই শুনতে পায় আগরতলা। সেখান থেকে পিটিআইয়ের টেলিপ্রিন্টার ও অন্যান্য সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় বিশ্বে। তাদের আগ্রহের আধিক্যে পূর্ববঙ্গের অভ্যন্তরে যেকোন ঘটনায় জীবনের ঝুঁকিসত্ত্বেও তারা সীমান্তে গিয়ে জড়ো হতো। শেষপর্যন্ত সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সীমান্তে ভিড় না করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। বলা হতোÑ এমন লোক সমাগমে মুক্তিফৌজের কার্যক্রমে বিঘœ ঘটতে পারে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালি, সিলেটের জন্য তুলনামূলক কাছাকাছি অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক, সামরিক নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই প্রথমে আগরতলা এসে আশ্রয় নেন। পাকবাহিনীর আক্রমণে সাধারণ মানুষ ২৬ মার্চের পর থেকেই ত্রিপুরার দিকে আসতে থাকলে পাহাড়ি-বাঙালি, জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে সকলেই সহানুভূতির সাথে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে একে অপরের সহমর্মী হয়ে উঠে। এক সময় শরণার্থীর সংখ্যা ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার বেশি হয়ে যায়।
তিনদিক থেকে পাকিস্তানবেষ্টিত ত্রিপুরা সামরিক দিক দিয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভূখ-। রাজ্যের ৯১৭ কি.মি. সীমান্তের মধ্যে ৮৩৯ কি.মি. পূর্ববঙ্গের সাথে। বাকি ৫৭ কি.মি. আসাম ও ২১ কি.মি. মিজোরামের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানিদের আক্রমণ কৌশলেও ত্রিপুরা ও রাজধানী শহর আগরতলাকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সীমান্তঘেঁষা রাজধানী ও বিভিন্ন মহকুমা শহর পাকসীমানা থেকে ভারি গোলার আওতায়। সে হিসাবে স্থানীয় লোকজনদেরই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। মূল ভূখ-ের সাথে যোগাযোগ মাধ্যম বিমান ব্যতীত অন্যান্য পথ নিতান্ত দুর্গম। কার্যত বিচ্ছিন্ন ত্রিপুরাবাসী তাই নিরুপায়। উপরন্তু স্থানীয় জনসংখ্যার দ্বিগুণসংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে এই শহরগুলি।
অবস্থানগত কারণে শরণার্থীর চাপ প্রথমেই সামলাতে হয় ত্রিপুরাকে। রাজ্যের জনসংখ্যার চেয়ে অধিক শরণার্থী গ্রহণ রাজ্যজুড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে ৩০টির মতো প্রশিক্ষণ শিবির, যুদ্ধশিবির, ভারতীয় সেনার বিপুল সমাবেশ সেই সাথে প্রথম থেকে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি গোলার আঘাত সইতে হয়েছে ত্রিপুরার মাটিকে, থাকতে হয়েছে বিমান আক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে। শিকার হতে হয়েছে আক্রমণের।
শুধু সামরিক গুরুত্বই নয়, রাজনৈতিক গুরুত্বও কম কোথায়। আগরতলা সার্কিট হাউজেই প্রথম গঠন হয়েছিল প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভা। ২৭ মার্চ সাব্রুম সীমান্তে পৌঁছেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, মনসুর আহমদ চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল হারুন, মির্জা আবু মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। অনেকেই এক বস্ত্রে চলে এসেছেন। এমআর সিদ্দিকী আসেন লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায়। খবর পেয়ে পুলিশের ডিআইজি তাদেরকে আগরতলায় এনে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের কাছে নিয়ে যান। নেতৃবৃন্দ বর্তমান পরিস্থিতি এবং তাদের আগমনের উদ্দেশ্য নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। ত্রিপুরা সরকার পূর্ব হতেই পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতির উপর বিশেষ নজর এবং ঘটনাবলির খোঁজখবর রাখছিল। ওপাড় থেকে আসা নেতাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে যাতে বাধা দেয়া না হয় এবং যারা আসবেন তাদের রাজ্যের অতিথি হিসেবে সম্মান প্রদর্শনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী বিশেষ নির্দেশ জারি করেন। পরবর্তীতে আসেন খন্দকার মোস্তাক আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মালেক উকিল, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আব্দুল হান্নান, অ্যাড. সিরাজুল হক, মমতাজ বেগম। ছাত্র ও যুবনেতাদের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, স্বপন চৌধুরী। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, কমরেড ফরহাদ, বজলুর রহমান, পঙ্কজ ভট্টাচার্র্য্য, জ্ঞান চক্রবর্তী, পুলিন দে, আব্দুস সালাম, খোকা রায়, শ্রমিক ও বামনেতাদের মধ্যে আবুল বাশার, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন, সিরাজুল হোসেন খান, হায়দার আকবর খান রনো, আব্দুল্লা আল নোমানসহ অনেক নেতা-কর্মী প্রথমে আগরতলায় এসে আশ্রয় নেন। কমরেড মনি সিংহ ও অনিমা সিংহ একসময় আগরতলায় অবস্থান করেছিলেন। মতিয়া চৌধুরী শিলং হয়ে আসেন আগরতলা। অবস্থান করেন সাত মাসেরও বেশি সময়।
কর্নেল (অব.) আতাউল গণি ওসমানী এমএনএ, কর্নেল (অব.) আব্দুল রব এমএনএ, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর মীর শওকত, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন এসএ ভূইয়া, ক্যাপ্টেন আমিন আহমদ চৌধুরী, গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার, উইং কমান্ডার বশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদর উদ্দিন, সুলতান মাহমুদ সবাই সমবেত হয়েছিলেন আগরতলায়। সামরিক নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম মেজর রফিকুল ইসলাম আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সাথে বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয় ৯২ বিএসএফ ব্যাটালিয়ন থেকে তাদের কিছু গোলা-বারুদ দেয়া হবে। তবে ব্যাপারটি সম্পর্কে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। কারণ ভারত সরকার এসব কিছুতে প্রকাশ্যে জড়াতে চাইছিল না।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান, ড. কোরেশী, রশিদুল হক, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, মমতাজ উদ্দিন, কামাল লোহানী, মুসতারি শফী, আলমগীর কবিরসহ অনেক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের প্রথম আশ্রয়স্থল আগরতলা।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কর্মীরাও চলে আসেন এখানে। চট্টগ্রাম কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্রটি পাকিস্তানি বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে বেতারকর্মীদের প্রচেষ্টায় প্রথমে রামগড়ে এবং পরে আগরতলার কাছে শালবনে স্থাপন করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র। ৩ এপ্রিল থেকে ২৪ মে পর্যন্ত এখান থেকেই প্রচারিত হয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান। ২৫ মে থেকে বেতারকেন্দ্র চালু হয় মুজিবনগরে। ২ এপ্রিল সাংবাদিক অনীল ভট্টাচার্য্যরে বাড়িতে আগরতলায় আশ্রয়গ্রহণকারী এমএনএ, এমপিএ-সহ ২৩ জন রাজনৈতিক নেতা এক সভায় মিলিত হয়ে ‘স্টপ দি জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে প্রেরণ করেন। সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে এ প্রস্তাব ছড়িয়ে দেয়া হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মালেক উকিল, নুরুল হক, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, এমএ হান্নান, আব্দুল্লাহ আল হারুন এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। দেশের বাইরে এটিই ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রথম সভা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে প্রথম বার্তা।
২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ঢাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং পরবর্তীতে দেশের সর্বত্র গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং নৃশংসতার যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে পাকবাহিনী, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য গ্রাম-গঞ্জ, প্রান্তর, নদী-খাল, বন-জঙ্গল অতিক্রম করে অসহায় মানুষ ছুটতে থাকে সীমান্তের দিকে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শত্রুর তাড়া খেয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ কসবা, সাব্রুম, সোনামোড়া, বেলুনিয়া, রামগড় সীমান্তে এসে ভিড় করতে থাকে। আগরতলার মহারাজার প্রাসাদের পাশে দুর্গা মন্দিরে স্থাপন করা হয় অভ্যর্থনাকেন্দ্র। এখান থেকে পাঠানো হয় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে। এয়ারপোর্টের কাছে মোহনপুর টিলায় তৈরি হয় বিশাল শরণার্থী শিবির। সূর্যমণি নগর, মেলাঘর, বিশালগড়, আমতলি, হাফানিয়া, উদয়পুর, বিশ্রামগঞ্জ, বরদোয়ালি, কোণবনে শরণার্থী শিবির স্থাপন করেও স্থান সংকুলান হয় না। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে ছেড়ে দেয়া হয় শরণার্থীদের থাকার জন্য। কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষাও স্থগিত করতে হয়েছে। ত্রিপুরার তিনটি জেলায় ২৭৬টি শিবিরে আশ্রয় নিয়ে আছে শরণার্থীরা। আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয়েও আছে অনেক। পরিচিত-অপরিচিত বাঙালি-পাহাড়ি নির্বিশেষে সবাই আশ্রয় দিচ্ছে এই অসহায় শরণার্থীদের। (চলবে)