সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরিতে সিলেটের অনেক পরিচিতজনের দেখা মিলে। কারো কাছ থেকে সুসংবাদ আশা করা নিরর্থক বরং অনেক নতুন দুঃসংবাদ পাওয়া গেল। প্রাণে বেঁচে থাকাটাই এখন ভালো খবর। জানা যায়, কী দুর্ভোগ-দুর্গতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা এসেছেন। সেনা টহল এড়িয়ে, বনপথে ঝোঁপ – ঝাড় – জঙ্গল মাড়িয়ে, কখনো নৌকা, কখনো রিকশা, বেবিটেক্সি, পায়ে হেঁটে, অচেনা অপরিচিত গৃহে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটিয়ে, কখনো রাতের অন্ধকারে এ পথ সে পথ ঘুরে তিন-চার দিনে চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে এসেছে। সাধ্যমত ঠাঁই দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, জাত-পাত, ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। নিরাপদ পথ বাতলে দিয়েছে। তবুও কত দুর্ভোগ দুর্ভাবনা। দলের লোকজন এমনকি পরিবারের কেউ কেউ পথিমধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন পথে ভিন্ন দিকে এসে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। সে তুলনায় আমরা অনেক ভাগ্যবান। তখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জ হানাদারমুক্ত থাকায় শহর এবং আশেপাশের মানুষদের পক্ষে সীমান্ত অতিক্রম করা মোটামুটি নিরাপদ ছিল। প্রকৃতির কল্যাণে নৌ চলাচলের সুবিধা এবং কাছাকাছি সীমান্ত আমাদেরকে অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করেছিল। মে মাসের ১০ তারিখ পাকসেনারা সুনামগঞ্জের দখল নিলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। সীমান্ত অতিক্রম করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরে শুরু হয় পাকবাহিনী ও সহযোগীদের তা-ব। মানুষের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কেবল আতঙ্ক – ভয় – ভীতি আর দুঃসহ দুর্ভোগ।
জেঠতুতো দাদার বাড়ি করিমগঞ্জ শহরের কাছাকাছি নিলাম বাজারে। ট্রেন, বাস দুটিতেই যাতায়াত চলে। স্বাধীনতা সংগ্রামী কাকা এবং এক পিসতুতো দাদা যারা দু’জনেই এক সময় দেশ উদ্ধারের ব্রত নিয়ে স্বদেশী যুগে জেল খেটেছিলেন, স্বাধীনতার পর জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয়ে দেশত্যাগ করে এখানে এসে সংসার পেতেছেন। একই জায়গায় আরো কয়েকজন আত্মীয় – স্বজনের বাস হওয়ায় নিজেদের নিয়েই এক নতুন সমাজ এখানে গড়ে উঠেছে। শুধু পরিবার নয়, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও জেঠামশাই বায়োজ্যেষ্ঠ। তাই গুরুজন হিসাবে উনার একটা শ্রদ্ধার আসন পাতা হয়ে আছে এখানে। নিজ পুত্র ও স্বজনদের মাঝে জেঠামশাই, জ্যেষ্ঠমা’র কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পুকুর-ঘাট, উঠোন, গাছপালা, নারিকেল – সুপারির সারিতে একটা বাড়ি বাড়ি ভাব থাকলেও দেশের বাড়িতে গাঁথা পড়ে থাকা জ্যেষ্ঠমার মনখারাপ থাকে সবসময়ই। আড়ালে চোখের জল মুছেন। আমার কাছে জানতে চান মঙ্গলি এঁড়ে বাছুর না বকনা বাছুর প্রসব করেছে। সন্ধ্যায় গোয়ালঘরে ধুনা দেয়া হয় কিনা। টুনুর মা, পাখির মা কি বালাটের ক্যাম্পে ঠিক মতো রেশন পাচ্ছে? ওখানে তো কলেরা দেখা দিয়েছে। ওদের কি অবস্থা হবে। কতোদিনে যুদ্ধ শেষ হবে। এমন আরো কত প্রশ্ন।
আত্মীয়তা সূত্রে সিলেট – সুনামগঞ্জের আরো কয়েকজন এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আসা যাওয়া করছেন কেউ কেউ। এখান ওখান থেকে নিয়ে আসেন সত্য-মিথ্যা খবরাখবর। রেডিও’র সংবাদ শোনা, পত্রিকার খবর আর যুদ্ধের আলাপ-আলোচনায় এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতিও কিছুটা বদলে গেছে। আগে দশটা বাজার আগেই সবাই ঘুমিয়ে পড়তো। এখন উঠোনে একত্রে জড়ো হয়ে দশটার সংবাদ পরিক্রমা, দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা কেন্দ্র, ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনে সবাই। সংবাদের গুরুত্ব এবং প্রতিক্রিয়ায় কখনো ক্ষোভ, কখনো উল্লাস আবার কখনো তর্ক-বিতর্কে প্রচলিত রাতের নীরবতা এখন আর নিস্তরঙ্গ নয়। দূরে কোথাও ধুম করে গোলার শব্দে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় উঠোন সমাবেশে।
নিলাম বাজারে দু’দিন কাটিয়ে শিলচর ফেরার পথে আবার করিমগঞ্জ। খোঁজে বের করলাম আমার আরেক না দেখা পিসতুতো দাদাকে। এক সময় সুনামগঞ্জে আমাদের বাসাতেই উনারা থাকতেন। পড়াশোনাও সেখানে। ভালো ফুটবল খেলতেন। আম্বিয়া ভাই (নুরুল হক আম্বিয়া)-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফুটবলার কন্টর ভাই, সমশের ভাইয়ের সাথে দেখা হলে সবার আগে হিরা দা’র খবর জানতে চাইতেন। আমি নিজেই উনাকে চিনতাম না, দেখিনি কোনদিন। বছরে দু’একটি চিঠি আসতো তাও গুরুজনদের কাছে। তবুও বলে দিতাম- হ্যাঁ, ভালোই আছেন। একসময় নাকি হিরাদা, আম্বিয়া ভাই এবং সুনীল দা এই ত্রিরতেœর বন্ধুত্ব প্রবাদের মতো ছিল। একজন হিন্দু, একজন মুসলিম অপর জন খ্রিস্টান। তিন জনই সজ্জন, অমায়িক। দোষের মধ্যে একটাই, খেলাপাগল। অনেকদিন হয় ছাড়াছাড়ি। তবুও মনের গহনে একজন আরেকজনের কাছাকাছি। সুনামগঞ্জ টাউনক্লাবে খেলতেন। এখন সে ক্লাবটি আর নেই। সেই হিরা দাকে খুঁজে পেলাম করিমগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনে। এখনো বিয়ে থা করেননি। সমাজসেবা খেলাধুলা নিয়ে বেশ আছেন। বাসার বড়দের কাছে হিরাদা’র গল্প শুনেছি। খুব নাকি মজার মানুয আর কৌতুকপ্রিয়। আমার নাম বললামÑ হারান, সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি। চিনতে পেরেছ? বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। ট্রাফিক পুলিশের মতো ডান হাত তোলে আমাকে থামিয়ে বললেনÑ আগে তোকে দেখে নেই। কোত্থেকে কি একটা এসেছিস। তারপর বলব চিনতে পারলাম কি না। অনেকক্ষণ আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে তীক্ষè পর্যবেক্ষণের পর তর্জনী নাড়াতে নাড়াতে বললেনÑ তোর, তখন এক বৎসরও হয়নি, সে সময় আমি দেশ ছেড়ে এসেছিলাম। বাড়ির সকলের ছোট ছিলি তুই। আরো অনেক গোলগাল চেহারা ছিল। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সব শেষে তোকে আদর করে ঘর থেকে যখন বেরিয়েছিলাম, তখন আমার খুব কান্না পেয়েছিল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম উনার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নিয়ে বললেন, সেই যে কেঁদেছিলাম আর আজ চোখ মুছলাম। এই বলে হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর স্বভাবসুলভ রসিকতায় চেঁচামেচি করে আশেপাশের ক’জনকে উদ্দেশ করে বললেনÑ এই দেখে যাও, আমাদের মিশনে এক রিফিউজি ঢুকে গেছে। দু’একজন ছুটেও এলো। আমাকে দেখিয়ে বললেনÑ আমার মামাতো ভাই। দু’হাত উপর-নিচ রেখে ছয় ইঞ্চির মতো জায়গা ফাঁক করে দেখিয়ে বললেন, এই এতটুকু দেখে এসেছিলাম।
নিজে নিজেই বলে যাচ্ছেন, আমরা তো উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলাম, ওরা এবার শরণার্থী। দেশমুক্ত করে আবার নাকি চলে যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে।
যাবার সময় হলে তখন যাবি এখন খেতে চল। মিশনে খাবারের পাঠ শেষ হয়ে গেছে আগেই। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন হোটেলে। খেতে খেতে কত কথা। আত্মীয়-স্বজন কে কোন দিক দিয়ে এসেছে, কে কোথায় আছে। জিজ্ঞেস করলেনÑ রফিকুল বারী সাহেবের বাসার কথা, মামা সাহেব (ইউনুস আলী পীর)-এর কথা, ভাই সাহেব (আব্দুজ জহুর এমপিএ)-এর কথা। জানতে চাইলেন, আম্বিয়া ভাই, কন্টর ভাই ওরা এখনো খেলেন কিনা। টাউন ক্লাব এখনও আছে কিনা। আরো কতো কিছু জানার কী ব্যাকুলতা। বুঝলাম, এই মুহূর্তে তার অন্তরজুড়ে কেবল সুনামগঞ্জের স্মৃতি টগবগ করছে। (চলবে)