1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ০৮:৫৮ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

ঝরাপাতার পান্ডুলিপি : শরর্ণাথী ৭১

  • আপডেট সময় রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬

সুখেন্দু সেন ::
(পূর্ব প্রকাশের পর)
জেঠামশাইকে লালপানিতে রেখে বাবা আসতে রাজি হলেন না। বালাটের ক্যাম্পে আমাদের আরেক কাকার পরিবারের সাথে থেকে গেলেন। মা এবং দুই দিদিকে নিয়ে জামাইবাবু বিকেলেই ফিরে এলেন। তিন দিন শিলং বাস শেষে এবার আমাদের গন্তব্য শিলচর। শহর থেকে নয়-দশ মাইল দূরে উদারবন্দে এয়ারপোর্ট রোডের উপর ভগ্নিপতি পরেশ রঞ্জন দেবের অফিস কাম রেসিডেন্ট। সেন্ট্রাল এক্সাইজের কর্মকর্তা। একজন কনস্টেবল ও একজন আর্দালী নিয়ে অফিস। বাসায় দিদি এবং ভাগ্নে-ভাগ্নি তিনজন। রাস্তার অপর পাশে নয়ারাম উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শরণার্থী ক্যাম্পে গিজগিজ করছে মানুষ। কে কোন দিকে এসে কোথায় কিভাবে আশ্রয় নিয়েছে তার ঠিক নেই। অস্বাভাবিক অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কোন নিয়মই কার্যকর থাকে না। গোলাগুলির মুখে জীবন বাঁচাতে ছুটে আসলেও সবাই যে বাঁচতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই। অনাহার, রোগ, শোক, মহামারি, মৃত্যু নিত্যসঙ্গী। আমরা নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছি ঠিকই কিন্তু দুর্ভাবনা-দুঃশ্চিন্তা পিছু ছাড়েনি। বাবা-জেঠারা এখন অনেক দূরের বালাট শরণার্থী শিবিরে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের সঙ্গে থাকা এক দিদির স্বামীর কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।
বাসার কাছাকাছি বইয়ের দোকান। বীণাপানি লাইব্রেরি। সংবাদপত্রেরও এজেন্ট। এখানে বসে সময় কাটাই বইপত্র, ম্যাগাজিন ঘেটে। আরো দু’চারজনও এসে জড়ো হয়। কলকাতার পত্রিকা বিমানে করে শিলচর আসে। কুম্ভিগ্রাম এয়ারপোর্ট থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার গাড়ি শহরে যাবার পথে পত্রিকার বান্ডিল লাইব্রেরির সামনে ফেলে যায়। তার অপেক্ষায় থাকি। আকাশে ডাকোটা বা ফকারফ্রেন্ডশিপ দেখা গেলেই বুঝতে পারি কখন পত্রিকা এসে পৌঁছবে। তড়িঘড়ি প্যাকেট খুলে একের পর এক পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে নেই। এখনকার সব গরম খবরÑ বাংলাদেশের যুদ্ধ, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় পাকসেনাদের অত্যাচার নির্যাতন হত্যাকা-, শরণার্থীর ক্রমবর্ধমান ¯্রােত, দুঃখ-কষ্ট-দুর্ভোগ। কলকাতার বাংলা কাগজগুলি এখন বাংলাদেশ নাম ব্যবহার করলেও ইংরেজি পত্রিকাগুলি ইস্টবেঙ্গল বা ইস্ট পাকিস্তান লিখে যাচ্ছে। জামাইবাবু ইংরেজি পত্রিকা অমৃতবাজার-এর পাঠক। আমাদের জন্য যুগান্তর। দোকানে বসে আনন্দবাজার, কালান্তর, বসুমতি, আগরতলা শিলচরের দু’তিনটি সাপ্তাহিক দৈনিকও পড়ে নেই।
আজকের যুগান্তরে একই সাথে বেশ কয়েকটি স্থানের শরণার্থীর সংবাদÑ হলদিবাড়ি শহরে বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য শরণার্থী আসতে থাকায় এক গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে। কুচবিহার জেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, দৈনিক গড়ে বারো হাজার মানুষ হলদিবাড়ি আসছেন। জেলা কর্তৃপক্ষ আরো বলেছেন, সীমান্ত পরিদর্শন করে দেখাগেছে বুধবার সীমান্তের ওপাড়ে আরো প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ এপাড়ে আসার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। কুচবিহার জেলার ছোট্ট শহর হলদিবাড়িতে এ পর্যন্ত দেড় লক্ষেরও বেশি শরণার্থী এসেছেন। বিভিন্ন বিদ্যালয় ভবন কিংবা খালি বাড়িতে প্রথমে এদের স্থান দেয়া হয়েছিল। এখন তাও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক শরণার্থী পরিবারকে আকাশের নিচে রাত কাটাতে হচ্ছে। অসহনীয় অবস্থার প্রতিকারের জন্য জেলা কর্তৃপক্ষ তাঁবু ও ঔষধপত্র চেয়েছেন।
শিলিগুড়ির নিজস্ব প্রতিনিধি লিখেছেন, আট বছরের তায়েব তার মা-বাবাকে হারিয়ে ইসলামপুর স্কুল ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। পাকদস্যুর গুলিতে তায়েবের মা-বাবা দু’জনই নিহত হন। ঠাকুরগাঁ শহরের রিকশাচালক তায়েবের বাবা ভেবে ছিল গরিবদের হয়তো মারবে না। পাকসেনারা আসার আগে অনেক লোকজন শহর ছেড়ে চলে গেলেও সে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু তায়েবের সামনেই তার মা-বাবাকে হত্যা করে পাঞ্জাবিরা। অন্য এক শরণার্থী দলের সাথে সাতদিনে নানা জায়গা ঘুরে জয়বাংলা সংগ্রাম সংহতি কমিটির ক্যাম্পে আশ্রয় পায়। তার এই অবস্থা সকলের অন্তর ছুঁয়ে গেছে। ক্যাম্পবাসী ও রিলিফকর্মী সকলের কাছেই সে খুব প্রিয়।
শরণার্থীর ¯্রােত সর্বত্র। মহকুমা শহর করিমগঞ্জ সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় সেখানে শরণার্থীর ¯্রােত বেশি। সিলেট শহরের লোকজন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরও ভিড়। কর্তৃপক্ষের নজরও সেদিকে বেশি। জেলা সদর শিলচরের কয়েকটি স্কুলও শরণার্থীদের দখলে। শহর থেকে কিছুটা দূরে উদারবন্দ নয়ারাম হাইস্কুলে বিচ্ছিন্নভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় গড়ে উঠায় কর্তৃপক্ষের নজরও কম। এখানকার সবাই অজগাঁয়ের শিক্ষাহীন-স্বাস্থ্যহীন হতদরিদ্র লোক। স্কুলপড়–য়া কোন ছাত্রেরও দেখা মেলে না। খোঁজ-খবর নেয়ার লোকজন যেমন কম, সুযোগ-সুবিধাও তেমনি কম। এর মধ্যেই আমাশয়-কলেরার মতো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে গেছে। প্রায় সময়ই কান্নার রোল কানে আসে। স্থানীয় লোকজন কলেরার ভয়ে মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলের ধারে কাছেও ঘেঁষে না। লাইব্রেরির আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা মোটামুটি সচেতন ও মন-মানসিকতায়ও কিছুটা অগ্রসর। চোখের সামনে অসহায় মানুষের এমন বিপর্যয় সকলের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। আমি নিজেও শরণার্থী। কাছাকাছি আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার আগ্রহ থেকেই আড্ডার চার-পাঁচ জনকে সঙ্গে নিয়ে ভালো-মন্দ বিচার বিশ্লেষণ না করেই জড়িয়ে যাই এই হতভাগ্যদের সুখ-দুঃখে। শ’খানেক পরিবার গাদাগাদি করে আছে। নোংরা পরিবেশ রোগ ছড়ানোর উপযুক্ত ক্ষেত্র যেন তৈরি করেই রেখেছে। দুর্গন্ধে বাতাসও বিষাক্ত ঠেকে। বসবাসকারীদের অসচেতনতা পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলেছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অসহায়। ডাক্তার বাবু নিরুপায়। হাজারখানেক লোকের এ যেন এক নরক বাস। বালাটে দশ-বারো দিন টংঘরে অবস্থানের দুর্ভোগ পোহালেও পরিস্থিতি এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল। অবশ্য মইলাম বিভীষিকার হৃদপি- খামছে ধরার মত ঘটনা প্রবাহ ঘটেছিল আরো পরে। নিকট আত্মীয়রা উদ্ধার না করলে হয়তো এ অবস্থাতে আমাদেরও পড়তে হতো। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে সামনাসামনি লড়ে যাওয়া যায় কিন্তু রোগ-জীবাণু কখন কিভাবে ছড়িয়ে যায় আর কাকে আক্রমণ করে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয় তা দেখা যায় না, বুঝা যায় না। আমাদের আর সাধ্য কি। নিজেদের বাসাবাড়ি থেকে সাগু-বার্লি অন্যান্য পথ্য তৈরি করে এনে রোগাক্রান্ত শিশুদের মুখে তুলে দিয়ে সেবাব্রতের প্রাথমিক সূচনা। পরে স্থানীয় লোকজনদের কাছ থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহ করে বিতরণ। শেষে স্যালাইন, কলেরার প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যস্ততায় কয়েকটি দিন।
কলেরার ভয়ে সকলেই আতঙ্কিত। বেশ ক’জন রোগী রয়েছে ক্যাম্পে। নিজেদেরও সাবধান থাকা উচিত। দিদির বাসায় থাকি। আশ্রিত বলা যাবে না, অতিথি বটে। বড় কুটুম হিসেবে সমাদরেরও কমতি নেই। কিছুটা বিব্রত বোধও করি। জামাইবাবুর তেমন ছুৎমার্গ নেই। তবে সতর্ক থাকার জন্য বলেন। সন্ধ্যায় কার্বলিক সাবান মেখে গরম জলে ¯œান করে ঘরে ঢুকি।
সকাল থেকেই রাস্তার দু’পাশ ধরে লালটুপিওয়ালা হোমগার্ড দাঁড়িয়ে আছে। দু’তিনটি পুলিশের গাড়ির আনাগোনা, অন্যরকম তৎপরতা। এতদিন শরণার্থীরা নিজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতো কিন্তু আজ বাইরের লোকজন এসে ঝাড়-পোছ দিচ্ছে, যত্রতত্র ব্লিচিং পাউডার ছড়াচ্ছে, ফিনাইল ঢালছে। শরণার্থী শিবিরের পরিচিত দুর্গন্ধ ছাপিয়ে সে এক অন্যরকম উগ্র গন্ধ বাতাস ভারি করে তুলেছে। এর মাঝেই জানাজানি হয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আসবেন, শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে। এ শিবিরটি খুব বড় নয় তবুও বিমান থেকে নেমে শহরের পথে প্রথম চোখে পড়া শিবিরটি দেখার আগ্রহ যদি প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, তাই আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রাখা হচ্ছে। স্থানীয় এক কর্মকর্তা লাইব্রেরিতে এসে আমাদেরকেও সেখানে থাকার জন্য বললেন। আমাদের এই দলে আমি একাই শরণার্থী। তাই আমার দায়িত্ব নাকি আরো বেশি। দায়িত্ব কর্তব্য বিবেচনায় না এনে সর্বাগ্রে কৌতূহলের তাড়নাতেই তাৎক্ষণিক চলে গেলাম স্কুলে। ততক্ষণে সামনের মাঠে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। হাঁড় জিরজিরে দরিদ্র সব লোক, মলিন পোষাক পরিচ্ছদ। প্রধানমন্ত্রী কি জিনিস তা তাদের বোধগম্য নয়। ইন্দিরা গান্ধী বললে, সেটি বুঝতে পারে। এমন প্রান্তজনদের সামনেই আজ উপস্থিত হবেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী, একি বাস্তব না অন্য কিছু। ছোটখাটো মহড়া হয়ে গেল। মহিলারা উলুধ্বনি দেবে। জয়বাংলা, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী জিন্দাবাদ, ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ কয়েকবার আগাম বলে ঠিকঠাক করে নেয়া হল। হীন বল, ক্ষীণ দেহে বেশ জোরেশোরেই গলা থেকে আওয়াজ বেরুলো। একটি শঙ্খও যোগাড় করা হয়েছে। কেউ কিছু বলতে চায় কিনা তাও জিজ্ঞাসা করা হল। যারা কোনদিন চেয়ারম্যান, মেম্বারের সাথে সাহস করে কিছু বলতে পেরেছে কি না সন্দেহ, তারা কথা বলবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে? না, তারা শুধু চোখ ভরে দেখতে চায়। গান্ধী নামের এই মানবীকে নয় সাক্ষাৎ দেবীকে। (চলবে)

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com