বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সুনামগঞ্জ জেলা শাখার নেতা ও কর্মী বন্ধুগণ
শুভেচ্ছা নিও,
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সুনামগঞ্জ জেলার প্রাক্তন কর্মী ছিলাম বলে সেই দাবি নিয়ে লিখছি।
তোমরা ডিজিটাল যুগের নেতা-কর্মী। তোমাদের হাতে এতো সময় ও ধৈর্য নেই আমার প্যানপ্যান আর ঘ্যানঘ্যান শুনার। তোমাদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, আইফোন আর ইন্টারনেট। তোমাদের অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে থাকো তাই আমিও ফেসবুকে তোমাদের পিছু নিয়েছি।
তোমরা কে হবে সভাপতি, কে হবে সেক্রেটারি, নয়তো অমুক নেতার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র তা নিয়েই তোমরা ব্যস্ত। তবুও আমার কথাটি যদি একটু শুনতে তাহলে কৃতার্থ হতাম।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অন্যন্য ত্যাগের ইতিহাস। তোমরা স্বাধীনতার জন্ম যন্ত্রণা দেখোনি, তোমরা বারুদে পোড়া স্বদেশের মাটি দেখোনি, তোমরা ভরা নদীতে শত শত মানুষের লাশ আর রক্তের ঢেউ দেখোনি। দেখোনি বলেই তোমাদের কাছে আমার এ খোলা চিঠি।
তোমরা অনেকেই জানো না এই নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ স¤পাদক বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে গিয়ে বীরত্বের সাথে লড়ে …গোলা-বারুদ শেষ হয়ে গেলে হাতাহাতি যুদ্ধে সুরমা নদীর উত্তর পাড়ে জাহাঙ্গীরনগর গ্রামের পাশে পাকবাহিনীর ঘেরাওয়ে পড়ে বন্দি হয়। ছাত্রলীগের এই বীর যোদ্ধাকে সুনামগঞ্জ শহরে এনে জনসভা করে প্রদর্শন ও মারপিট করে, পরে তাকে আহসানমারা নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। আজও কান্নায় বুক ভেঙ্গে যায় যখন মনে পড়ে, আমরা বিজয় উল্লাসের মাঝে ৮ই ডিসেম্বর ছাত্রলীগ কার্যালয়ে বসে মিষ্টি খাচ্ছিলাম ঠিক তখনি শহীদ তালেবের মা পাগলের মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন Ñ তোমরাতো ফিরে এলে বাবারা কিন্তু আমার তালেব কই? শুনেছি পাক-সেনারা তাকে হত্যা করেছে… আমাকে তার কবরের পাশে নিয়ে যাও। আমি তার কবরটি একবার দেখব!
কিন্তু পারিনি, অবশ্য পেরেছি অনেক পরে। অনেক চেষ্টার পরে জনৈক রাজাকারের সহায়তায় তার কঙ্কাল উদ্ধার করে উজানীগাঁও হাই স্কুলের সামনে দাফন করার মাধ্যমে।
তার করুণ আর্তনাদে সেইদিন ছাত্রলীগ অফিসে উপস্থিত সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সৃষ্টি হয় এক করুণ হৃদয় বিদারক আর্তনাদের দৃশ্য। আজো নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ এলে বন্ধু শহীদ তালেবের মায়ের অশ্রুর তপ্ত ফোটা আমার বুকের যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাটায় যেনো তীব্র বেদনায় ঘা মেরে ওঠে।
পাঠক,
সে দিনের সেই করুণ দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়ার মতো কলম পৃথিবীতে এখনও তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার এতো বছর পরেও সেই করুণ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পাকসেনাদের তীব্র গোলাগুলির মধ্যে অক্ষত থেকে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি সত্য, সাথী বন্ধু ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ আলী আজগরও শহীদ হয়েছে, সেই কাঁটা আমাকে আজও ক্ষত-বিক্ষত করে। স্বাধীনতার পর তালেবের স্মৃতি যাতে অমলিন থাকে সে জন্য সুনামগঞ্জ সরকারি মহাবিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রাবাসটির নামকরণ করা হয় শহীদ তালেব উদ্দিন ছাত্রাবাস। কিন্তু ১৯৭৫-এর পর ষড়যন্ত্রকারীরা শহীদ তালেবের নাম মুছে ফেলার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তোমরা লক্ষ্য রাখবে এই ভবনটি যথাযথ মর্যাদায় তালেবের নামে যেনো রাখা হয়।
আমি যখন মুক্তিসংগ্রাম স্মৃতি ট্রাস্টের সাধারণ স¤পাদক ছিলাম তখন কলেজে তালেব, জগৎজ্যোতি, আলী আজগর ও গিয়াসের নামে একটি ফলক নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় কলেজ কর্তৃপক্ষ পুরাতন স্মৃতি ফলকটি ভেঙ্গে নতুন স্মৃতি ফলক স্থাপন করেন। সেই ফলকে ছাত্রলীগ নেতা আলী আজগরের নাম নেই। দেশের জন্য এই কলেজের ছাত্র আলী আজগর প্রাণ দিল আর তার নাম ছাঁটাই করার অধিকার মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিল কে?
ছাত্রলীগের বন্ধুরা তোমাদের পূর্বসূরীরা ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে যুব সমাজের নেতৃত্ব দানকারী। তোমরা তাদের উত্তরসূরী পূর্বসূরীদের মান মর্যাদা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমাদের। পূর্বপুরুষের দায় তো উত্তর পুরুষদের নিতেই হবে। আবারো বলছি মুক্তিযুদ্ধ নিরন্তর, এর শেষ নেই। তোমরা হবে বীর যোদ্ধা, সত্য, ন্যায় ও আগামীর যুদ্ধে।
তোমাদের সবার জীবন সুন্দর হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তোমাদের হৃদয়ে চির জাগ্রত থাকুক।
শুভ কামনায় Ñ
মতিউর রহমান
তোমাদের আগামী দিনের সহযোদ্ধা।