মতিউর রহমান ::
আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে ১৯৩৬ সালে নভেম্বর মাসের শীতকালে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কপথে মোটরগাড়ি চালু হয়। গাড়ি ছিল ফোর্টিফোর মডেলের, যাত্রীরা ডাকতেন ‘মুড়ির টিন’ বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বৃটিশের ফেলে দেয়ার মতো গাড়িগুলো কিনে ঠিকঠাক করে গাড়ির মালিকরা যাত্রীসেবার জন্য আমাদের বাপ-দাদাদেরকে উপহার দেন। গাড়ির সামনের দিকে বহু কসরত করে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করা হতো। তাই গাড়ির কন্ডাকটারকে হ্যান্ডিম্যান বলা হতো। কিছুক্ষণ চলার পর ইঞ্জিনের মাথা গরম হয়ে যেতো, রাস্তার পাশের খাদ থেকে পানি ঢেলে ঠান্ডা করা হতো। রাস্তা ছিল সরু, কাঁচা, একটু বৃষ্টি হলে ভরে যেত কাদায়। তখন সবাই মিলে ঠেলতে হতো গাড়ি। চারটি ফেরি ছিল তাও ইঞ্জিন ছাড়া, দুই পাড়ে থাকতো রশি বাঁধা। যাত্রীরা দড়ি টেনে ফেরি এপাড় থেকে ওপাড়ে নিয়ে যেতেন। গাড়ি ঠেলা ও দড়ি টানায় একটি উপকার হতো, তা হলো কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ থাকলে জীবনের তরে এ রোগের আর ঔষধ খেতে হতো না!
রাস্তায় কাদা যাতে না হয় সেজন্য ফেলা হতো বড় বড় বোল্ডার আর পাথর। বোল্ডারের উপর দিয়ে গাড়ি যখন চলতো তখন মনে হতো গাড়িতে না উঠে, উঠেছি নাগরদোলায়। ঝাঁকুনিতে রোগী আর বয়স্কদের হতো বেহাল অবস্থা। সরু রাস্তা দিয়ে একসাথে দু’টি গাড়ি চলতে পারতো না। ড্রাইভার সাহেব বহু কষ্ট করে অন্যটিকে পাস দিতেন। পাস দেওয়ার সময় মনে হতো এই বুঝি গাড়ি উল্টে পড়ে মরি।
বর্তমানে চালু গাড়ি হতে তখনকার গাড়ির সিটের ব্যবস্থা ভালো ছিল। গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে তিনজন ও দু’টি আপার ক্লাসে পাঁচজন করে দশজন বসার ব্যবস্থা ছিল। আপারে সিলেট যাওয়ার ভাড়া তিন টাকা আর লোয়ার ক্লাসে আড়াই টাকা। সুনামগঞ্জ পুরাতন জেলের কোণা হতে গাড়ি ছেড়ে সিলেট দিলশাদ সিনেমা হলের একটু দূরে গিয়ে গাড়ি থামতো। সে যাই হোক কপাল ভালো হলে বিয়াল্লিশ মাইল পথ পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায় যাওয়া যেতো। তবে সিলেট পৌঁছার পর ধুলো আর কাদায় যাত্রীদেরকে হনুমানের মতো মনে হতো।
আমার যতো দূর মনে পড়ে ছিয়াত্তর-সাতাত্তর সালে বহু আন্দোলন সংগ্রামের ফলে প্রশাসন সুনামগঞ্জের বুক হতে চুয়াল্লিশ মডেলের গাড়ি তুলে চালু করে মিনিবাস বা গাড়ির বাচ্চা। যা বাংলাদেশের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়ার জন্য ব্যবহার হয় না।
চুয়াল্লিশ মডেলের গাড়ির পেট বড় থাকায় যাত্রীরা আরামে বসতে পারতেন কিন্তু মিনিবাসের বডি ষোড়শী সুন্দরীর মতো স্লিম হওয়ায় সিটগুলোও স্লিম হতে হতে বসার অযোগ্য। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো। গাড়ির মালিক প্লাস্টিক সার্জারি করে ত্রিশ সিট থেকে চৌত্রিশ সিটের ব্যবস্থা করেছেন। রাস্তার উপর যত্রতত্র গাড়ি রাখা, যাত্রী উঠানো-নামানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো, বেশি ভাড়া নেওয়া, বিরতিহীনের নামে রাস্তায় যাত্রী তোলা এগুলো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে ফেরি নেই, বর্তমান সরকারের আমলে তেরোটি প্রশস্ত ব্রিজ হয়েছে। পিচঢালা রাস্তা থাকা সত্বেও সময় লাগে তিন ঘণ্টা। বিরতিহীনে লাগে দুই ঘণ্টা।
সহৃদয় পাঠক আশি বছর আগের বৃটিশের ফেলে যাওয়া গাড়ি, বর্তমানে চালু মিনিবাসের তফাৎটা কি? কারণ ফেরির সময় এখন অপচয় হয় না, ঘুরে ফেরে তো একই অবস্থা।
এসমস্ত তদারকি করার জন্য কেউ কি নেই? শুনেছি বিআরটিএ নামক একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এসমস্ত গাড়ির অনিয়ম দূর করে আইনের আওতায় আনা তাদের কাজ। কিন্তু অনিয়মকারীদের কেশাগ্র ছেঁড়া তো দূরের কথা ছোঁতেই পারছে না।
একটি বাস্তব ঘটনা লিখে শেষ করছি। সদ্য নির্বাচিত একজন প্রতিনিধি সিলেট থেকে সুনামগঞ্জে আসার পথে বাসে উঠলে কন্ডাকটার তাকে খাতির করে সামনের সিটে বসায়। ভদ্রলোক একটু মোটা হওয়ায় সিটের অধিকাংশ জায়গা তার দখলে চলে যায়। রাস্তায় কোনো যাত্রী তাকে সম্মান করে পাশে বসে না। জনপ্রতিনিধি তাকে খাতির করা হয়েছে মনে করে হৃষ্টচিত্তে সুনামগঞ্জে আসেন। এসে নামামাত্র কন্ডাকটার বলেÑ ভাড়া দেন। ভদ্রলোক বলেনÑ আমিতো টিকিট করে গাড়িতে উঠেছি। কন্ডাকটার রেগে-মেগে বলে বাকি আরেক সিটের… যেটা আপনার জন্য খালি এসেছে। কন্ডাকটার আর জনপ্রতিনিধির কথা কাটাকাটির সময় জনতার ভিড় জমে উঠে। পরবর্তীতে গাড়ির ম্যানেজারের হস্তক্ষেপে জনপ্রতিনিধি রক্ষা পেয়ে মানসম্মান নিয়ে বাড়িতে আসেন।
এ অবস্থা আর কতোদিন চলবে? এ অনিয়মের কি প্রতিকার নেই? আরামদায়ক বাস চড়ার অধিকার কি সুনামগঞ্জের মানুষের নেই? জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের সুফল আমরা কি পাবোনা? এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?