চৌধুরী মঞ্জুর আহমদ ::
সুরেশ বাবু চলে গেলেন। এবার সত্যি সত্যি চলেই গেলেন। প্রথমবার তাঁকে পরপারে পাঠানোর জন্য আরও অনেকের সাথে ব্যাক টু ফেস্ সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানো হয় পঁচিশের কালো রাতে। যে না ফেরা দেশে তাঁকে পুশ করার প্রচেষ্টা চলছিল সে দেশ তাঁকে নিতে চায়নি বলে তিনি পুশব্যাক হয়ে জঘন্য এক হত্যাযজ্ঞের জীবন্ত সাক্ষী রূপে রয়ে গেলেন। জীবনভর তিনি বলতে পারতেন, বধ্যভূমিতে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত বাংলার মানচিত্র রূপে মনে হলো, যখন ঊষার রক্তিম আলোয় উপলব্ধি করলাম স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বুলেট হজম করে আমি জীবন্ত আছি। ‘সাম্টাইমস্ ট্রুথ্ ইজ স্ট্রেনজার দেন ফিক্শন’ ঘটনাটিকে আমরা এরূপেও ভাবতে পারি। কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের শ্মশান ফেরত ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’Ñ এরকম অনুভব করতেও পারি।
তাঁকে স্বল্পভাষী বলে ধারণা করতাম। অবশ্য সুনামগঞ্জ বারে তাঁর আইনজ্ঞ সাথীরা এ ব্যাপারে ভালোই জানবেন। আমি মনে করি যারা কম কথা বলেন, তারা নিজেকে প্রকাশ করতে কুণ্ঠা বোধ করেন। সুরেশ বাবু’র সাথে তেমন মেলামেশার সুযোগ না পেলেও দূর থেকে তাকে দেখেছি ও অনুভব করেছি। সরকারি জুবিলী স্কুলে ১৯৫০-এর দশকে আমরা সমসাময়িক ছিলাম। আমরা একই শ্রেণিতে না পড়লেও তিনি আমার এক ক্লাস পরের ছাত্র ছিলেন। তখন স্কুল ক্যাম্পাসের ভিতরে হিন্দু ছাত্রাবাসে থাকতেন। দীর্ঘ সময় ছাত্রাবাসের মনিটর ছিলেন। বিজ্ঞান শিক্ষক কামিনী স্যার হোস্টেল সুপার ছিলেন। আমি আর বন্ধু গোলাম রব্বানী এক নাগাড়ে দেড় দু’বছর প্রাইভেট পড়তে যেতাম মাগরিবের নামাজের পর যখন আমরা ক্লাস নাইন ও টেন-এ পড়তাম। তখন প্রায়ই ভাই সুরেশের সাথে দেখা হত। স্কুলের পর কলেজে প্রবেশের পর থেকে তাঁর সাথে আর দেখা-সাক্ষাত হয়নি। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগের আশায় কুমিল্লার বন্ধু রেজার (অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমানÑসিনিয়র প্রসিকিউটর যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত মামলাসমূহ এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সম্মানিত সদস্য) হাত ধরে ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রবেশ করার পর থেকে জগন্নাথ হলের বোর্ডার ও বিশিষ্ট ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী হিসেবে তাঁকে দেখতাম। কাছাকাছি আসার সুযোগ থাকলেও অদৃশ্য এক বিভাজন বিদ্যমান ছিল। সেটা ছিল রাজনৈতিক। তৎকালীন সর্ববৃহৎ এবং আদর্শবান ছাত্র সংগঠন ছিল পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ঊচঝট)। আন্তর্জাতিক পোলারাইজেশনের প্রভাবে ঊচঝট দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
সে যা হোক ১৯৬৯-এর উত্তাল গণজাগরণের বিভিন্ন মিছিলে ও ছাত্র সমাবেশে প্রায়ই তাঁর সরব উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন ও সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্রভাবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আর ইকবাল হল ছিল সূতিকাগার। তুখোড় ছাত্রনেতারা এবং নেতৃবৃন্দ যারা যুবনেতায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন সবাই ইকবাল হলে শলা-পরামর্শের জন্য এসে বসতেন। ছাত্র ইউনিয়নের গুলজার ভাই, নুরুল ইসলাম নাহিদ (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) ইকবাল হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। আমরা তাঁকে নুরুল ইসলাম ভাই বলে চিনতাম। তোফায়েল আহমেদ, আ.স.ম. রবসহ তৎকালীন ছাত্রলীগের বড়-ছোট দাগের নেতাকর্মীতে ইকবাল হল ভরপুর ছিল। অ্যাডভোকেট সুরেশকে হলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে গুলজার ভাই, নুরুল ইসলাম ভাই এবং অন্যান্য নেতাকর্মীর সাক্ষাতে আসতে দেখতাম। সংগঠনের আদর্শতার বিরোধের কারণে আমরা এক হতে পারিনি। অ্যাডভোকেট সুরেশ দাস সম্পর্কে আমার আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয় ১৯৭১ এপ্রিলের প্রথম দিকে। পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগের ছাত্র নাসিরুল ইসলাম বাচ্চু (বাড়ি রংপুর) ঢাকার কেরানীগঞ্জ হয়ে কখনো নদীপথে এবং কখনো ডাঙায় পায়ে হেঁটে সুনামগঞ্জ চলে আসে ডা. আবুল লেইস সাহেবের বাসায় যাওয়ার জন্য। সে মরহুম ডাক্তার সাহেবের শ্বশুরকুলের দিক থেকে আত্মীয় হতো। সুনামগঞ্জ আসার পরই তাঁর সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। সে-ই আমাদের প্রথম জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ম্যাসাকারের ঘটনাবলি, সুরেশ বাবুর বিস্ময়কর মৃত্যুঞ্জয়ী উপাখ্যানসহ বিস্তারিত জানায়। তখন থেকে ভাই সুরেশকে একবার চাক্ষুষ দেখার আগ্রহ লালন করতে থাকি। ১৯৭১ সালে আর সে সুযোগ মেলেনি। স্বাধীনতার পর কোথায় কখন আবার দেখা হয়েছিল নবজীবনপ্রাপ্ত এই সুরেশ দাসের সাথে এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে এতটুকু মনে আছে যে, দীর্ঘক্ষণ গলা শুকানো পিপাসার পর হঠাৎ সুপেয় পানি গলাধঃকরণ করলে যে প্রশান্তি বোধ হয় তাঁকে দেখে সেরকম অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা যতই বলাবলি করি না কেন সুরেশ জানতে পারবেন না তিনি আর ফিরে আসবে না। আদালতের ফুলকোর্ট রেভারেন্সে তাঁর স্মরণে নীরবতা জীবিতদের হৃদয়ে শুধু বিষণœতা সৃষ্টি করে যার রেশ হয়তো দু’একদিনে বিলীন হয়ে যাবে। ভাই সুরেশের ইতি হলেও যতোবার ২৫শে মার্চের দিনগুলো আসবে আমার মতো কোনো কোনো মানুষের স্মৃতিতে সুরেশ ভেসে উঠবে।
[লেখক চৌধুরী মঞ্জুর আহমদ সুনামগঞ্জের সন্তান। বর্তমানে চট্টগ্রামের বাসিন্দা]