1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ০৩:১১ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

রক্তাক্ত চিনি-কাণ্ড

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬

পাভেল পার্থ ::
এ দেশের প্রতিটি শস্যফসলের গায়ে লেগে আছে অন্যায় জুলুম আর জখমের নির্দয় ক্ষত। বাংলাদেশে নীল, তামাক, চা, রাবার, ভুট্টা, তুলা আর আখের শরীরে এই ক্ষত সবচে’ বেশি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নীল উৎপাদন ও রপ্তানির ব্যবসা রমরমা হওয়ায় এবং বিশ্ববাজারে নীলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জমিদারেরা তাদের দরিদ্র কৃষক রায়ত প্রজাদের দিয়ে জোর করে নীল উৎপাদন করতে বাধ্য করাতেন। ধীরে ধীরে ধান ও শস্য ফসল, পাট, তেল, তুলার জমিগুলো হতে থাকে নীলের জমি। কৃষক হারায় নিজস্ব শস্য ফসলের অধিকার। নীল উৎপাদকদের সবচেয়ে বেশি পুঁজি লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন এজেন্সি হাউজ ও ইউনিয়ন ব্যাংক অব ক্যালকাটা ১৮৪৭ সালে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। ঊনিশ শতকের পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে এসব কৃষি জমির উপর দিয়ে রেললাইন বসানোর ফলে গ্রামীণ সমাজে কৃষি মজুরের মজুরি হার বেড়ে যায়। কিন্তু নীল ব্যবসায়ী জমিদারেরা নীলচাষীদের কম মজুরি নিতে বাধ্য করে। এ অবস্থায় সংগঠিত নীল চাষীরা অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু করে এক ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ। ঊনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে এবং ষাটের দশকের প্রথম দিকে নীলচাষ অঞ্চলগুলোতে এই বিদ্রোহ সহিংস হয়ে ওঠে। নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের শহীদ হন অনেক বিদ্রোহী নীল চাষী কৃষক প্রজা। দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলদর্পণ নাটক, কিশোরী চাঁদ ও হরিশ চন্দ্র মুখার্জীর পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি নিপীড়িত নীলচাষীদের পক্ষে জনমত তৈরি করে। ১৮৬০ সালে সরকারের গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনের পর জোরপূর্বক নীলচাষ বন্ধ হয়। এখনও দেশের অঞ্চলে এরকম অনেক নীলকুঠি অত্যাচারী জমিদার ও জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গ্রামীণ কৃষক সমাজের আপন খাদ্য ও কৃষি অধিকার রক্তাক্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলের মতোই ব্রিটিশ উপনিবেশ চাবাগানে, জোরজুলুম করে আদিবাসী শ্রমিকদের মেরেকেটে চা বাণিজ্য চালু করা হয়। প্রাকৃতিক শালবন, সিলেটের বর্ষারণ্য আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বন নিশ্চিহ্ন করে শুরু হয় বাণিজ্যিক রাবার বাগান। দেশের কৃষিজমি ও নদী দুমরেমুচরে শুরু হয় বাণিজ্যিক তামাক আবাদ। একইভাবে কর্পোরেট কোম্পানির রাসায়নিক পণ্যর বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতে শুরু হয় হাইব্রিড ভুট্টার চুক্তিবদ্ধ চাষ। চলতি আলাপখানি নীল, চা, তামাক, রাবার বা ভুট্টা নিয়ে নয়। চলতি আলাপখানি আখ নিয়ে, বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদনের জন্য যে আখ মূলত কারখানার সাথে চুক্তিবদ্ধ শর্তেই চাষ করা হয়।
নীল আর চায়ের মতো বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদনের জন্য আখও জোরজুলুমের সাক্ষী। তবে তা ব্রিটিশ উপনিবেশ বা পাকিস্তানে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশেই। চিনিশিল্প টিকিয়ে রাখতে ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল’ সম্প্রতি মানুষ খুন করেছে, আহত করেছে অনেককে। ২০১৬ সনের ৬ নভেম্বর রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল কর্তৃপক্ষ তাদের শ্রমিক-কর্মচারী ও ভাড়াটে মাস্তান বাহিনী নিয়ে হামলা চালায় গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর গ্রামের নিরীহ আদিবাসী ও বাঙালিদের উপর। চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ভাষ্য তারা জমি থেকে বীজ-আখ কাটতে সেখানে গিয়ে ‘অবৈধ দখলদারদের’ উচ্ছেদ করেছে। পুলিশ ও চিনিকলের আক্রমণে নিহত মঙ্গল মার্ডী (৫০) এবং শ্যামল হেমব্রমের (৩৫) লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ মঙ্গল মার্ডীর লাশ নিয়ে গেছে। মুংলী সরেন ও রুবেন সরেন নামে দুই সাঁওতাল প্রবীণকে ঘটনার পর থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তাক্ত এই চিনিকান্ডের গভীরে যে গোপন ক্ষত আছে রাষ্ট্রকে তা জানতে ও বুঝতে হবে। রক্তাক্ত চিনি-কান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা যাদেরকে মেরেকেটে বারবার উচ্ছেদ করছেন, যাদের বারবার ‘অবৈধ দখলদার’ বলছেন তারা আসলেই কারা? কীসের ভিত্তিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমির প্রকৃত উত্তরাধিকারদের ‘অবৈধ দখলদার’ আখ্যা দিয়ে বারবার হামলা করছে? খুন জখম করছে? কীসের স্বার্থে, কার প্ররোচনায়? দেশের চিনিশিল্প টিকিয়ে রাখতে মানুষ হত্যার এই নির্দেশ নিশ্চয়ই সরকার দেয়নি। তাহলে বারবার গোবিন্দগঞ্জে যে জখম আর জবরদস্তি চলছে রাষ্ট্র কেন তা ফায়সালা করছে না? রাষ্ট্র কেন গোবিন্দগঞ্জে রক্তাক্ত চিনিকান্ড থামাচ্ছে না। এই রক্তাক্ত চিনিকান্ডের পেছনে রয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও তাদের সাথে জড়িত স্বার্থান্বেষীদের গভীর গোপন ষড়যন্ত্র ও জালিয়াতি। আছে উপনিবেশিক ক্ষমতার বাহাদুরি আর কর্পোরেট সন্ত্রাস। হয়তো এরা সকলে মিলে সরকারকে একটা বড় ধরনের বেকায়দায় ফেলতে চাইছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে গ্রামীণ গরিব নি¤œবর্গকে উসকে দিতে চাইছে।
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরহিমপুর মৌজার ১৮৪২.৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার। এলাকাটি সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম নামে পরিচিত। অধিগ্রহণের ফলে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম ও ৫টি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ হয়। কথা ছিল অধিগ্রহণের নামে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া এই জমিনে আখ চাষ হবে। আখ ভিন্ন অন্য কোনো ফসল চাষ করা হলে বা চিনিকলের উদ্দেশ্যর সাথে সম্পর্কহীন কোনোকিছু করা হলে কেড়ে নেয়া এসব জমি আবারো ভূমিমালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুণ ৩১ মার্চ ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সনের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে তারা উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টি-কুমড়ার আবাদ দেখতে পান। এরই ভেতর গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন ১০ মে ২০১৬ তারিখে উক্ত ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন সরকার বরাবর। বাপ-দাদার জমিনে অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে আদিবাসী-বাঙালি ভূমিহীনদের তৈরি হয়েছে ভূমি আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে ভূমিহীনদের সংগ্রামে খুন-জখম-হামলা-মামলার বাহাদুরি চালানো হচ্ছে।
অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া জমিনে ভূমি উদ্বাস্তু প্রায় ৪০০০ পরিবার মাদারপুর মৌজার কুয়ামারা পুকুরের উত্তর ও দক্ষিণে এবং নরেঙ্গাবাদ মৌজার বাছুরমারী পুকুরের উত্তর-পশ্চিমপাড়ে ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস শুরু করে। সাঁওতালরা তাদের মানঝিথান তৈরি করেছে, বাঙালি মুসলিমরা মসজিদ ঘর তুলেছে, জমিনে খেসারীকলাইসহ শস্য ফসল বুনেছে। ২০১৬ সনের ১ জুলাই চিনিকল কর্তৃপক্ষ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা পাঁচটি মৌজায় পরিদর্শন করে নিজেদের জমিনে নতুনভাবে বসতিস্থাপনকারী ভূমিমালিকদের ঘরবাড়ি তুলে চলে যাওয়ার কথা বলেন। ২০১৬ সনের ১২ জুলাই মিল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশের গুলিতে বেলোয়া গ্রামের মাঝি হেমব্রম, বুলাকিপুর গ্রামের মাইকেল মার্ডি, গুচ্ছগ্রামের সোবান মুরমু ও বেলোয়া গ্রামের মুংলী টুডু চারজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং অনেকেই আহত হয়।
এইসব ঘটাচ্ছে কারা, কার স্বার্থে? জমির ভীষণ ঊর্ধ্বমুখী দামের এই দেশে ১৮৪২.৩০ একর জমির লোভ কে ছাড়তে পারে? তাও যদি তা হয় গরিব মেহনতি আদিবাসী আর বাঙালি নি¤œবর্গের। যে চিনিকল বারবার বন্ধ হয়ে যায়, আখ চাষ না করে জমি ইজারা দিয়ে দেয় সেই চিনিকল বীজ-আখ উদ্ধারের জন্য মানুষ খুন করে ফেলে এমন ‘শিল্পদরদী চিনিকলের’ দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।
[পাভেল পার্থ : গবেষক ও লেখক। ধহরসরংঃনধহমষধ@মসধরষ.পড়স]

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com