স্টাফ রিপোর্টার ::
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ সুনামগঞ্জে ফের বন্যার শঙ্কা জাগিয়ে তুলছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সুরমা নদীর পানি আবারও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত দুই দিন হাওর ও নদীতে পানি বাড়ে। এ কারণে নতুন করে আবারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন মানুষজন।
এরই মধ্যে তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে। নতুন করে পানিবন্দি হয়েছেন এসব এলাকার কয়েক লাখ মানুষ। টানা বৃষ্টিতে সুরমা নদীর পানি একাধিক পয়েন্টে বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর সড়ক ডুবে যাওয়ায় জেলা শহরের সাথে বন্ধ রয়েছে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল নেমে সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী নদী ধোপাজান, যাদুকাটা ও পাটলাই এবং খাসিয়ামারা, চেলা নদী দিয়ে দ্রুতবেগে পানি প্রবাহিত হয়ে জেলার প্রধান নদী সুরমার বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। দ্বিতীয় দফা বন্যার পানি কিছুটা কমে যাওয়ার পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেকেই নিজ বাড়িতে ফিরেছিলেন। কিন্তু তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ফের বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন অনেকেই। ইতিমধ্যে বাসাবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন কেউ কেউ। এদিকে সুনামগঞ্জের ২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচ শতাধিক বন্যার্থী এখনো রয়েছেন। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে আরো বন্যার্তরা এসে উঠতে পারেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৯টায় সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে ছাড়িয়ে যায়। দুপুর ১২টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর এলাকায় সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে ছাতক উপজেলা শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫৫ মিলিমিটার আর চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত ১৬০ মিলিমিটার। দিনে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানি ২০ সেন্টিমিটার কমে আসলেও উজানে বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা থাকায় ফের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার।
অপরদিকে, সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এমন পূর্বাভাসে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন পানিবন্দি এলাকার মানুষজন। দীর্ঘদিন পানিবন্দি থাকায় কর্মহীন অবস্থায় নি¤œ আয়ের মানুষজন। এছাড়া চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দুর্গত এলাকার নারী, শিশুসহ বয়স্করা। এই পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা চেয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বড়পাড়ার বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, আমরা খুব কষ্টে আছি। একবার পানি নামলে আবার উঠে। এই কষ্টের অবসান কবে হবে জানিনা। সরকার যদি কোনো ব্যবস্থা না করে তাইলে মাইনষের যাওয়ার জায়গা নেই।
জামালগঞ্জ উপজেলা ভীমখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্তার হোসেন বলেন, তৃতীয় দফায় বানের পানিতে নতুন করে ডুবছে বাড়ি ঘর। মানুষের কষ্টের অন্ত নেই। বড় বিপাকে মানুষ।
তাহিরপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি সেলিম আখঞ্জি জানান, তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের দুটি স্থানে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার জেলা শহরের সাথে তাহিরপুর উপজেলায় সরাসরি যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে গত দুই দিন ধরে। এরই মধ্যে অনেক পর্যটকসহ সর্ব সাধারণ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও উপজেলার নি¤œাঞ্চলের বসতবাড়িতে পানি উঠেছে।
তাহিরপুরের দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমদ মোরাদ জানান, আমার ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের চারপাশে শুধুই হাওর। বর্ষায় ঘর থেকে বের হলেই নৌকা নিতে হয়। সড়ক পথে কোনো ব্যবস্থা নেই। আর এক মাসের মধ্যে তিন বার বন্যা দেখা দেয়ার আমার ইউনিয়নের মানুষজন চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। হাওরের ঢেউয়ে বসতবাড়ি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে অনেকের বসতবাড়ি ভেঙে গেছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ ও উজানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও কোথাও কোথাও অবনতি হতে পারে। তবে বন্যার ভয়াবহতা ততোটা মারাত্মক আকার ধারণ করবেনা। ভারী বৃষ্টি না হলে পানি কমবে।
এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ত্রাণ সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী। সরকারি বরাদ্দ পর্যাপ্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ১৬ জুন পাহাড়ি ঢল এবং টানা বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় বন্যা কবলিত হয়। পরে সব নদ-নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও গত ৩০ জুন থেকে আবারও টানা বর্ষণে বন্যার কবলে পড়ে জেলার ৫টি উপজেলার মানুষ। ৯ জুলাই পানি কমে নদীর মাত্র ৪৪ সেন্টিমিটার নিচে নেমেছিল। কিন্তু গত দুই দিনে পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে আবারও নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন উপজেলার নি¤œাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে