শামস শামীম ::
রংপুরের গাইবান্দা জেলা সদরে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে দুর্নীতি ও অনিয়মের জড়িয়ে পড়ায় বিভাগীয় মামলার পর দুর্গম পাহাড়ি জনপদ রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলায় পানিশমেন্ট বদলি করা হয় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় কর্মরত বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুস সালামকে। সেখানে গিয়েও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় আবারও হাওরের দুর্গম উপজেলা শাল্লায় বদলি করা হয় ২০২৩ সনের জুন মাসে। এই দুর্গম জনপদে এসেও তিনি ঘুষের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেছেন। আকণ্ঠ ডুবে আছেন দুর্নীতিতে। দুর্নীতির কারণে মন্ত্রণালয় তাকে চাকুরি থেকে তিন ধাপ অবনমিত করলেও দুর্নীতি ও অনিয়মে এক বেপরোয়া কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের দিয়ে একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পূর্বের কর্মস্থলে দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় মামলার পর প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় আব্দুস সালামকে চাকুরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যক্তিগত হাজিরায় অংশ নিয়ে মানবিক ক্ষমা প্রার্থনা করায় তাকে চাকুরিচ্যুতির বদলে ৩ ধাপ অবনমিত করে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পাহাড়ি এলাকা থেকে পানিশমেন্ট বদলি হিসেবে দুর্গম হাওরের শাল্লা উপজেলায় বদলি করা হয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মো. আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ৩ (খ), ও ৩ (ঘ) মোতাবেক অসদাচারণ ও দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা করা হয় ২০১৮ সালে। ২০১৯ সালে এ বিষয়ে অভিযোগনামা প্রেরণ করে তার জবাব চাইলে ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশও নেন তিনি। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন উপসচিব নাজমা শেখকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্তে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের দালিলিক প্রমাণ পেয়ে প্রতিবেদন জমা দেন তদন্তকারী ওই কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সালামকে দুর্নীতির অভিযোগে বিধি ৪ (৩) খ অনুযায়ী বাধ্যতামূলক অবসরের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে ফের তার বক্তব্যের জন্য জবাব চায় কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে প্রমাণিত কর্মকর্তা আব্দুস সালাম দ্বিতীয়বারও জবাব দেন। মামলায় আনীত সবগুলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। কিন্তু মানবিক কারণে চাকুরিচ্যুতির গুরুদ- হ্রাস করে একই বিধিমালায় বিধি ৪ (৩) (ক) অনুযায়ী নি¤œ বেতন গ্রেড অবনমিতকরণ করে ২০২৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গুরুদ- প্রদান করে মন্ত্রণালয়। ৬ষ্ঠ গ্রেড থেকে নামিয়ে তাকে নবম গ্রেডে অবনমতি করা হয়। ৫ বছর পর্যন্ত এই আদেশ বলবৎ থাকার কথা বলা হয় প্রজ্ঞাপনে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ স্বাক্ষরিত আদেশে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় এই শাস্তি দেওয়া সালামকে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- আব্দুস সালাম রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা জেলার গাইবান্ধা সদর উপজেলার উপজেলা শিক্ষা অফিসার থাকাকালে স্লিপ ফান্ডের অর্থ ছাড়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে ৩০ হাজার করে টাকা আদায়, বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামত এর কমিশন গ্রহণ, প্রাক প্রাথমিক শ্রেণির উপকরণ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থের ছাড়ের জন্য ঘুষগ্রহণ, নতুন শিক্ষকদের জিপিএফ ফাল্ড খোলার জন্য ঘুষ গ্রহণ, বিদ্যালয়ের ল্যাপটপ বিতরণে ঘুষ গ্রহণ, শ্রান্তি বিনোদন ভাতাপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করেন। ঘুষ না দিলে সার্ভিসবুকে বিরূপ মন্তব্য করতেন তিনি। ২০১৮ সালে প্রাথমিকে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পোষ্য কোটার প্রার্থীদের সনদপত্র দেবার নামে ঘুষ গ্রহণের প্রমাণ পায় মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। এসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পরই তাকে গাইবান্ধা থেকে রাঙামাটির বরকল এবং পরে দুর্গম শাল্লা উপজেলায় পানিশমেন্ট বদলি করা হয়।
শাল্লা উপজেলার শিক্ষক ও স্থানীয় সুধীজনদের সঙ্গে কথা বলে এবং শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্নীতির লেনদেনের অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, শাল্লায় এসেও গাইবান্ধার মতো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। দুর্গম হাওর উপজেলায় এসে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। স্লিপ ফান্ড থেকে অর্থ আদায়, ক্ষুদ্র মেরামত থেকে অর্থ আদায়, প্রাক প্রাথমিকে শিক্ষা উপকরণের বরাদ্দ থেকে অর্থ আদায়, শ্রান্তি বিনোদন থেকে কমিশন গ্রহণ, সরকারি স্কুল নির্মাণ কার্যক্রম থেকে ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঘুষ নিয়ে নি¤œমানের কাজে সহযোগিতা করা এবং ফাঁকিবাজ কিছু শিক্ষক স্কুলে না যাওয়ার সুযোগে মাসোহারা আদায় করছেন।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এমন একাধিক শিক্ষক জানান, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শাল্লা উপজেলা প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষকের হাওরভাতা বন্ধ ছিল। বন্ধ ভাতা চালু করতে মো. আব্দুস সালাম ১ হাজার ২০০ টাকা করে ঘুষ নেন প্রত্যেকের কাছ থেকে। টাকা প্রদানকারী একাধিক শিক্ষকের অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। শুধু এই দুর্নীতি ও অনিয়মই নয় সম্প্রতি অনলাইন বদলি কার্যক্রমের সময়ও তিনি দালাল শিক্ষক নেতাদের মাধ্যমে আইপিএমএসআই তথ্যের অনুমোদনে, একই উপজেলা ও আন্তঃউপজেলা বদলির আবেদনকারীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে অর্থ নিয়েছেন। যারা টাকা দেননি তাদের আবেদন বৈধ থাকলেও তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। সম্প্রতি এক শিক্ষিকার কাছে ঘুষ দাবি করায় ওই শিক্ষিকার স্বামী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে গত অক্টোবর মাসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছিল।
প্রতাপপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘুঙ্গিয়ারগাঁও মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ঘনিষ্ঠ দুই শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্যার ঘুষ খাওয়ার সিস্টেম জানেন। এ ক্ষেত্রে তার কোনও ডরভয় নাই। অনলাইন বদলি হয়ে একটি উপজেলায় আসা একজন শিক্ষক জানান, অগ্রবর্তী প্রতিবেদনের জন্যও স্যার টাকা নিয়েছেন। যারা দেয়নি তাদেরটা বাতিল করে দিয়েছেন বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও।
শাল্লার বাসিন্দা ও সুনামগঞ্জ জেলা ঐক্য ন্যাপের সভাপতি গোপেন্দ্র সমাজপতি বলেন, শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম দুর্নীতিতে বেপরোয়া একজন কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে দুর্নীতিবাজ হিসেবে তিনি প্রমাণিত হওয়ার পর এখানে এসেও দুর্নীতির সা¤্রাজ্য বিস্তার করেছেন। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তিনি শাস্তির ভয় করেন না। হাওর ভাতার জন্য প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। স্লিপ, ক্ষুদ্র মেরামত, শিক্ষা উপকরণ, শ্রান্তি বিনোদনসহ বিভিন্ন খাত থেকেও তিনি সরাসরিই ঘুষ নেন। একাধিক শিক্ষক আমাদের কাছে বলেছেন।
শাল্লা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অবনী মোহন দাস বলেন, আমি নতুন নির্বাচিত হয়ে এসেছি। শাল্লার ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষিকা ও তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে জেনেছি এই শিক্ষা কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত। তিনি এর আগেও দুর্নীতি করে এখানে পানিশমেন্ট বদলি হয়ে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় দুর্নীতির জন্য চাকুরিচ্যুত করেছে বলেও শুনেছি।
অভিযুক্ত শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুস সালাম মন্ত্রণালয় কর্তৃক দুর্নীতির অভিযোগে অবনমিতকরণের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে দুদকও তদন্ত করে নথিজাত করে। তারা মন্ত্রণালয় পুনরায় তদন্ত করতে পারেনা। যার জন্য হাইকোর্ট এসব দেখে হাসে। অবনমিতকরণ সারাদেশের অনেক কর্মকর্তার রুটিন কাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষা অফিসার এসব কাজ করে। আপনারা শুধু আমাদের দুর্নীতি দেখেন, আমাদের দুর্দশা দেখেন না। তবে এ ঘটনায় তিনি আপিল করেছেন বলে জানান।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস বলেন, শাল্লা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের অবনমিতকরণের বিষয়টি জানি। তার আপিলের বিষয়টি আমি জানিনা। শাল্লায় কোনও অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে আমরাও তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করবো।