স্টাফ রিপোর্টার ::
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির ৩য় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ শহরের কাজির পয়েন্ট এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনের আলোচনা সভা শেষে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে কার্যকরী সভাপতি করা হয়েছে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায়, সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. শহীদুজ্জামান চৌধুরী ও সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায়কে।
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায়ের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. শহীদুজ্জামান চৌধুরী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার, কবি ও লেখক সুখেন্দু সেন, মৌলভীবাজার জেলার শাহাদাৎ হোসাইন, হবিগঞ্জ জেলার চৌধুরী মিসবাহুল বারী, সিলেটের সেলিম চৌধুরী, নেত্রকোণা জেলার মোনায়েম খান, হবিগঞ্জের সেলিম চৌধুরী, সুনামগঞ্জের ইয়াকুব বখত বাহলুল।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ স¤পাদক বিজন সেন রায়।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হাওর বাঁচাও আন্দোলনের একে কুদরত পাশা, ওবায়দুল হক মিলন, শহীদ নুর আহমদ, নারীনেত্রী সঞ্চিতা চৌধুরী, সিলেটের অ্যাড. সুব্রত দাস, জামালগঞ্জ উপজেলার অঞ্জন পুরকায়স্থ, মো. মিসবাহ উদ্দিন, দিরাই উপজেলার সামছুল ইসলাম সর্দার, ছাতক উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম, শান্তিগঞ্জ উপজেলার আবু সাঈদ, নজরুল ইসলাম, রাধিকা রঞ্জন তালুকদার, অরুণ কান্তি দাস। আলোচনা সভাশেষে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। নতুন কমিটি ঘোষণা করেন কার্যকরী সভাপতি অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায়।
এর আগে বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় ‘জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা ২০২৩’ পাওয়ায় তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছাসহ অভিনন্দন জানান সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে বিজন সেন রায় বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। কৃষকদের ঘরে ফসল তোলাতে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাধিকবার মামলা করেছি। আমাদের আইনের আশ্রয়ে যেতে হয়েছে। আগামীতে এই কমিটির কর্মসূচিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব বখত বাহলুল বলেন, হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠন করার প্রেক্ষাপট আমরা সবাই জানি। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি হওয়ায় ফসলহানি ঘটে। তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু’র উদ্যোগে হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন নামে কমিটি হয়। তখন ওই কমিটি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এই সময় যারা দুর্নীতি করেছিল এই দুর্নীতিবাজদের হাতকড়া পরিয়ে ছিলাম আমরা। এরপর এই সংগঠন হাওরের ৭ জেলায় বিস্তৃতি ঘটে। পরে সংগঠনের নামকরণ হয় ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’। কৃষকদের উপকারে এবারও সাংগঠনিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। হাওর উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
হবিগঞ্জের সংগঠক সেলিম চৌধুরী বলেন, বৃহত্তর সিলেটে যথাযথ উন্নয়ন না হওয়ায় আমরা বার বার বন্যায় কবলিত হচ্ছি। হাওর, নদী, খাল ও বিলের খনন না হওয়ায় আমরা জলাবদ্ধতায় প্লাবিত হচ্ছি। বন্যার হাত থেকে বাঁচতে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
নেত্রকোণা জেলার সংগঠক মোনায়েম খান বলেন, নেত্রকোণার হাওরে যে ধান উৎপন্ন হয়, সেই ধান দেশ ও বিদেশে রপ্তানি হয়। হাওরের কৃষকদের বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে সরকারকে পর্যাপ্ত বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের ফলে খাল-বিল, নদী-নালা আজ ভরে গেছে। পানি নিষ্কাশন ও নৌপথ রক্ষা করে পরিকল্পিতভাবে বাঁধের কাজ করতে হবে। ফসল উৎপাদন ও মাছের উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
সিলেটের সংগঠক সেলিম চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভাটি অঞ্চলের উন্নয়নে অবহেলা করে আসছেন। তাই হাওর উন্নয়নে কোনো কাজ হচ্ছে না।
হবিগঞ্জ জেলার সংগঠক চৌধুরী মিসবাহুল বারী বলেন, হাওর বাঁচাও আন্দোলন একটি খুবই শক্তিশালী সংগঠন। এই সংগঠনের আন্দোলনে কৃষকেরা উপকৃত হচ্ছেন। আরও শক্তিশালী করতে যুব সমাজকে সংগঠনে স¤পৃক্ত করতে হবে। এতে সাংগঠনিক কাজের অগ্রগতি বাড়বে।
মৌলভীবাজার জেলার শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, পরিকল্পিত ও নৌ-পথ রক্ষা করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হাওর উন্নয়নে আলাদা মন্ত্রণালয় প্রয়োজন। হাওর বাঁচলে, ফসল বাঁচবে। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
কবি ও লেখক সুখেন্দু সেন বলেন, হাওর বাঁচাও আন্দোলন ৭টি জেলা নিয়ে গঠিত। নানা সমস্যায় সকলের অংশগ্রহণে আমরা বার বার সফল হয়েছি। যেকোনো জেলায় কোনো সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করলে আমরাও সক্রিয় অংশগ্রহণ করবো। ৭ জেলায় একযোগে কর্মসূচি পালন করবো। তিনি সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, সুনামগঞ্জে বাঁধ শুভংকরের ফাঁকির মতো হয়ে গেছে। বাঁধ আর বেড়িবাঁধে চলছে ফাঁকি। ঠিকাদারি পদ্ধতিতে যেভাবে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি কাটা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে পিআইসি পদ্ধতিতে চলছে বাঁধ বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ। কোনো বাঁধ সাসটেনেইবল হয়নি। সামান্য আগাম বন্যা হলেই বুঝা যেতো পিআইসিরা কত সৎ। সব বাঁধ ভেঙে যেতো। বাঁধের কাজে দুর্নীতি অব্যাহত আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড যেমন খুশি বাঁধের টাকা লুটপাট করে আসছে। আমরা তা প্রতিরোধ করবোই।
অ্যাড. শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এই সংগঠন ভাটি অঞ্চলের প্রতিবাদী খ্যাত সচেতন মানুষের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এই সংগঠনে জেলা বারের সদস্যরা অংশ নিয়ে অবদান রেখে আসছেন। ২০১৭ সালে বাঁধের দুর্নীতি নিয়ে মামলা হয়েছিল। তখন দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানতে পারি যে, ৬০% এর উপরে যারা বাঁধের কাজ করেছেন তারা আসামি হয়েছেন। যারা কোনো কাজ করাননি, তারা আসামি নন। ওই সময় ১ জন আসামিকে এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে তাকেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যারা আসামি হওয়ার মতো তারা আসামি হননি। তিনি আরও বলেন, আগামীতে বাঁধের দুর্নীতি নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে আসবে। তখন যারা ছাড়া পেয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পুনরায় আটক হবেন। বর্তমানে বাঁধে অপরিকল্পিত মাটি ভরাটের কারণে খাল বিল ভরাট হয়ে গেছে। এটা গুরুত্বসহকারে দেখা সকলের প্রয়োজন।
সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায় বলেন, সংগঠন চলবে সাংগঠনিক নিয়ম-নীতি অনুসারে। কৃষকদের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে সকলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। এতেই সাংগঠনিক কাজে সফলতা আসবে।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া কোনো দাবি আদায় হয় না। এই জন্য হাওরের উন্নয়নে হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠন হয়েছে ৭টি জেলা নিয়ে। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৭ জেলায় প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করেন। প্রাকৃতিক কারণে সুনামগঞ্জ থেকে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। তিনি বলেন, ১৯৭১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নৌ-পথ ছিল ২ হাজার ২১ কিলোমিটার। ইতোমধ্যে প্রায় ১৮ হাজার নৌ-পথ বিলুপ্ত হয়েছে। নৌ-পথ বিলুপ্ত ও জলবায়ু পরিবর্তন সহ নানা কারণে আজ জলাবদ্ধতা ও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এসব প্রতিরোধে প্রকৃতিবান্ধব আন্দোলন করতে হবে সকলে।