বিশেষ প্রতিনিধি ::
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় ঈদের আনন্দ এবার মাটি হয়েছে সুনামগঞ্জবাসীর। ঈদের দিন সোমবার (১৭ জুন) থেকেই বাড়তে থাকে পানি। দোয়ারাবাজার ও ছাতক প্লাবিত হয় ঈদের দিন। ডুবে যায় সড়ক জনপদ। পরদিন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। এরপর থেকে ভাটির আরো কয়েকটি উপজেলা বন্যা কবলিত হলেও বন্যায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ সয়েছেন দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার শহর ও শহরতলির বাসিন্দারা। চারদিন পর পানি নামতে শুরু করে। সপ্তাহখানেক পর ঝলমলে রোদের দেখা পেয়ে স্বস্তিতে ছিলেন বন্যার্ত লোকজন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
সুনামগঞ্জে বন্যাপরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বাসাবাড়ি সড়ক থেকে নামছে বন্যার পানি। তবে বন্যা পরিস্থিতি আবারও সৃষ্টির আশঙ্কায় আরো আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার ১৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে ছাতকেও পানি কমেছে। তবে ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার কমে। এই সময়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ২ মিলিমিটার। চেরাপুঞ্জিতেও অল্প বৃষ্টিপাত হয়েছে। ছাতকেও সুরমা নদীর পানি এই সময়ে ৩১ সেন্টিমিটার কমেছে। পুরাতন সুরমা নদীতেও ২ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। এভাবে নদ নদীর পানি কমায় ডুবে যাওয়া সড়ক, জনপদ ভেসে ওঠছে।
অপরদিকে, এদিকে বানভাসী লোকজন আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে বাসাবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে সুনামগঞ্জ শহরের দেখার হাওরের তীরে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটে এখনো পানি রয়ে গেছে। হাওর বন্যার পানিতে টইটুম্বুর থাকায় এসব এলাকার পানি ধীরে নামছে। তবে নদী তীরবর্তী এলাকার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় স্বস্তিতে আছেন বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা।
এদিকে, সরেজমিন দেখা গেছে সুনামগঞ্জ ও ছাতক পৌর শহরের হাওরঘেঁষা বাসাবাড়িতে এখনো পানি রয়ে গেছে। ডুবে আছে এসব এলাকার রাস্তাঘাট। এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শহরের সাহেববাড়ি, উত্তর আরপিননগর, উত্তর মল্লিকপুর, লঞ্চঘাট, উকিলপাড়া, ষোলঘর, বড়পাড়া, তেঘরিয়া, মধ্যবাজার, নতুনপাড়া, হাজিপাড়া ঘুরে দেখা গেছে এসব পাড়ার রাস্তাঘাট ও বাসাবাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে।
শুক্রবার ও শনিবার দিনভর রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া ছিল। এতে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হওয়া উপকরণ ও আসবাবপত্র শুকাতে দেখা গেছে ভুক্তভোগীদের। তবে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ৩নং ওয়ার্ডের খেজাউড়া পাড়ায় গিয়ে দেখা যায় পাকা সড়কটিতে পানি রয়েছে। আশপাশের প্রতিটি বাসায় পানি। বাসা থেকে মূল সড়কে আসতে পানি ভেঙ্গে আসতে হচ্ছে স্থানীয়দের। কালিপুর, পূর্ব নতুনপাড়া, পূর্ব মল্লিকপুর, পূর্ব ওয়েজখালিতে পানি রয়ে গেছে। অপরিকল্পিত ও নিচু বাসাবাড়ি নির্মাণ, নিচু সড়ক নির্মাণ, জলাধার ভরাটসহ নানা কারণে পৌর এলাকার বিভিন্ন পাড়ায় বন্যার পানি বিলম্বে নামছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
হাসননগর কেজাউড়া পাড়ার বাসিন্দা জাহেরা খাতুন স্বামী, সন্তান ও পরিবারের লোকদের নিয়ে ঈদের দিন ওঠেছেন হাসননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে। তার বাসায় বুকপানি ছিল। এখন আছে হাঁটুপানি। তবে দিনে ২-৩ বার বাসায় এসে আসবাবপত্র ঠিক আছে কি না দেখে যান। এই পাড়ার অন্তত ৪০টি পরিবার ওই আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন বলে জানান তিনি। আশ্রয়কেন্দ্রে তারা কোন ত্রাণ না পেলেও কয়েকবার রান্না করা খিচুড়ি পেয়েছেন বলে জানান এই নারী। তবে বন্যায় তার বাসার আসবাবপত্রের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে জেলার ৮১টি ইউনিয়নে বন্যা কবলিত হয়েছিল প্রায় ৮ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ। তাদের জন্য ৭০২টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৮৩টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২৩ হাজার ৮৪৯ জন বানভাসি আশ্রয় নিয়েছিলেন। শুক্রবার থেকেই পানি কমায় মানুষজন বাসাবাড়িতে ফিরতে শুরু করেন। গতকাল শনিবার পর্যন্ত ২০ হাজার ১২৬ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়ে গেছেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমার পানি বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার নিচ প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময়ে ছাতক পয়েন্টেও একই নদীর পানি কমেছে। তবে এখনো ছাতকে ৭০ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মানুষজন আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে বাসা বাড়িতে ফিরছেন। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন তাদেরকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।