বাংলাদেশি নাগরিকদের পাসপোর্টে একসময় লেখা থাকতো- ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সসেপ্ট ইসরায়েল, তাইওয়ান অ্যান্ড দ্য রিপাবলিক অব সাউথ আফ্রিকা’। পরবর্তীতে তাইওয়ান ও সাউথ আফ্রিকা বাদ দেওয়া হয় এবং হাতে লেখা পাসপোর্ট এমনকি এরপর মেশিন রিডেবল (এমআরপি) পাসপোর্টেও লেখা থাকতো- ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সেপ্ট ইসরায়েল।’ অর্থাৎ এই পাসপোর্ট ইসরায়েল ব্যতীত পৃথিবীর সব দেশের জন্য বৈধ বা এই পাসপোর্ট নিয়ে ইসরায়েল ছাড়া পৃথিবীর যেকোনও দেশে যাওয়া যাবে।
কিন্তু ই-পাসপোর্টে এই বাক্যটি পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে: ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিস অব দ্য ওয়ার্ল্ড।’ অর্থাৎ ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি ২০২১ সালের ঘটনা। কিন্তু এর তিন বছর পরে সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ শব্দ বাদ দেওয়া দুঃখজনক। শুধু তাই নয়, তিনি দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অন্য কেউ তার সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই পাসপোর্টে এমন পরিবর্তন করা হয়েছে। আব্দুল মোমেন বলেন, পাসপোর্টকে আরও মানস¤পন্ন করা এবং খরচ কমানোর জন্য জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করেছে বলে তাকে জানানো হয়েছিল। (প্রথম আলো, ৩১ মে ২০২৪)।
পাসপোর্টকে সর্বজনীন করার জন্য ‘ইসরায়েল ব্যতীত’ শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়তো যৌক্তিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাসপোর্ট থেকে এত গুরুত্বপূর্ণ দুটি শব্দ বাদ দেওয়া হলো স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া বা তাকে না জানিয়ে? এটাও সম্ভব?
দ্বিতীয়ত, পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েল ব্যতীত শব্দ দুটি বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে কি পরিবর্তন এসেছে? ইসরায়েলের ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন মানে মুক্তিকামী ফিলিস্তিনের ব্যাপারেও নীতিতে পরিবর্তন – যে ফিলিস্তিনের পক্ষে সরাসরি অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার লিখিতভাবে ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই থেকেই বাংলাদেশের অবস্থান ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু সরকারের ওই ঘোষণা ও অবস্থানের লিগ্যাসি বহন করেছে পরবর্তী প্রতিটি সরকার, এমনকি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও। তিনি বা তার সরকার যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ব্যাপারে নীতি পরিবর্তন করেছেন, এমনটি শোনা যায়নি। তাহলে পাসপোর্টে এই পরিবর্তন হলো কী করে এবং স্বয়ং পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত কে নিলেন?
অফিসিয়ালি পাসপোর্টের বিষয়টি দেখভাল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু যখন এখানে বৈদেশিক সম্পর্কের কোনও বিষয় থাকে স্বভাবতই সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে চলে যায়। অতএব, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া পাসপোর্টে এত বড় পরিবর্তন কী করে সম্ভব হলো – সেটি বিরাট প্রশ্ন।
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। অর্থাৎ যখন পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েল ব্যতীত শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হলো, তখন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন কী বলেছিলেন?
ওই সময়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্টে ইসরায়েলের নাম বাদ দেওয়া হলেও দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স¤পর্ক না থাকার কারণে বাংলাদেশিরা ইসরায়েলে যেতে পারবেন না।” ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনও ধরনের কূটনৈতিক স¤পর্ক প্রতিষ্ঠা করছে না বলেও জানান তিনি। (বিবিসি বাংলা, ২৪ মে ২০২১)। তার মানে পাসপোর্ট থেকে যে ইসরায়েল ব্যতীত কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানতেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পাসপোর্টে এই পরিবর্তনের বিষয়টি এমন সময় সামনে আসে যখন সারা বিশ্বে ফিলিস্তিন ইস্যুতে নতুন করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে