পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক (আইজিপি) বেনজির আহমদের আয়বহির্ভূত সম্পদ নিয়ে দেশে আলোচনা-সমালোচনার তোলপাড় চলছে। এই সম্পদের পরিমাণ কতো সুনির্দিষ্টভাবে এখনও নির্ণিত হয়নি। তবে একথা অনায়াসে অনুমিত যে, বেনজির যে সম্পদের মালিক হয়েছেন সে-পরিমাণ সম্পদ তার চাকুরির বেতনের আয়ে সম্ভব নয়। যেহেতু তার চাকুরির আয়টা কেবল তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে যথেষ্ট। তিনি যে বেতন পান সে বেতনের আয়ের দ্বারা বাড়তি সম্পদ সঞ্চয় করা একবারেই অসম্ভব। এর নিহিতার্থ একটাই : যে-পরিমাণ সম্পদ তার মালিকানায় সঞ্চিত হয়েছে তার সবটাই আয়বহির্ভূত উপার্জন, অর্থাৎ তিনি তা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন। তাছাড়া ভাবুন একবার, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তাঁর সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণটা তার বেতনের আয়ের টাকার হাজার কোটি গুণকে ছাড়িয়ে গেছে। হাজারবার জন্ম নিয়ে হাজারবার আইজিপির চাকরি করলেও তিনি বৈধ উপায়ে এতো টাকা আয় করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই আমলাদের হাতে প্রশাসনিক দপ্তরের কর্তৃত্ব ন্যস্ত থাকে। এই কারণে আসলে যে-কোনও দেশ পরিচালনা করেন আমলারা। তাই দেশের মানুষের সুখী, সুন্দর, সুস্থ ও উন্নত জীবননির্বাহের সার্বিক দায়ভার থাকে আমলাদের হাতে। এ কারণে আমলাদের নীতিনিষ্ঠ হতে হয়, বিপরীতে আমলারা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে জনগণের জীবনে নেমে আসে দুর্গতি। আমাদের বাংলাদেশে আসলে তাই হয়েছে, আমলাদের প্রচ- প্রভাবশালী একটি দুর্নীতিবাজ অংশ পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটাকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে সম্পদ আত্মসাতের হাতিয়ার করে তোলেছে। বেনজির ও তার মতো আমলারা বাংলাদেশটাকে পিছিয়ে রেখেছে। তারা ভাবছে না দেশের মানুষের কথা, দেশের কথা। তারা ভাবছে কেবল নিজের স্ত্রী-পুত্র, নাতিপুতির কথা। তারা দেশের সম্পদ চুরি করে নিয়ে বিদেশে চলে গিয়ে স্বজনসহ বসবাসের চিন্তা করছে, দেশের ক্ষতি হলে তাদের কীছু যায় আসে না। দেশটা তাদের কাছে একটা ক্ষেতখামারের মতো, এখানে সম্পদের চাষ করো আর বিদেশে গিয়ে বাস করো। সোজা একটি হিসাব।
বোধ করি এই জন্যে আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র সস্পর্কে বিদগ্ধজনের ধারণা একটু অন্যরকম। তাঁরা মনে করেন, আমলাতন্ত্রের ধর্ম হলো বাহ্যিক অনুষ্ঠানসর্বস্বতার পরিসরে চূড়ান্ত জনবিচ্ছিন্নতা, নিষ্প্রাণতা, ছলচাতুরীসহ সর্বোপরি জনসম্পদ আত্মসাৎপ্রবণ কাঠামোগত সহিংসতার অবিচ্ছেদ্য সহায়ক হয়ে উঠা।
এই জনবিরোধী ও জনবিচ্ছিন্ন আমলাতন্ত্রকে পাল্টে দিতে হবে। এখনই পাল্টে দিতে না পারলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সার্বিক উন্নয়ন কীছুতেই সম্ভব নয়। অর্থাৎ বেনজিরদের মতো আমলা দিয়ে পরিচালিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে পাল্টে দিয়ে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলতে হবে। জনগণকে সুখি, সমৃদ্ধ ও জনমেধা বিকাশে প্রতিবন্ধকতাহীন সমাজব্যবস্থায় পৌঁছে দিতে চাইলে বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রকে বদলে দেওয়ার কোনও বিকল্প নেই। আমাদের রাজনীতিবিদদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভাবনায় উৎসাহী হয়ে রাজনীতির ধারাকে আমলানির্ভরতা কাটিয়ে জনমুখি ও জননির্ভর করে তোলতে হবে। এককথায় দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের বিনাশ চাই, অর্থাৎ দুর্নীতিমুক্ত আমলাতন্ত্র চাই।