উভয়ে বিরোধী দল হলেও রকমফেরে বিএনপি-জাতীয় পার্টি। বিএনপির নাম রাজপথের বিরোধী দল। জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দল। এই বিরোধী দলটি নেতায় ভরপুর। নেতৃত্ব উপচে পড়ছে। এরপরও তার ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। আছে অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা। আর রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় টানা ১৬-১৭ বছর। ঈদের পর, শীতের পর, বর্ষার পর ডেডলাইন তো আছেই। এর পরও ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখে দলটির নেতাকর্মীসহ ভক্ত-সমর্থক অনেকে।
আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল টানা একুশ বছর। সংখ্যা হিসেবে বিএনপির সেখানে যেতে বা একুশ বছর হতে আরও বছর চারেক বাকি। গত ১৬-১৭ বছর ধরে ক্ষমতাহীন দলটি পোহাচ্ছে নানা ঝক্কিঝামেলা। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষায় : প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন কঠিন সময় আর পার করেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগ আর বিএনপির বিরোধী দলে থাকা ও দুর্গতি পোহানোর সময়, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট একেবারে ভিন্ন। রকমফের বিস্তর। এরপরও বিএনপি আশা দেখে। যদিও দৃশ্যত এখন পর্যন্ত সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ার মতো রাজপথের আন্দোলন বিএনপি জমাতে পারেনি। আবার দমেওনি। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন-কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী মনে করছেন দলটির আশাবাদী মহল। উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে তৃণমূলে চলমান বিশৃঙ্খলায়ও হতাশ নন তারা।
জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও বয়কট করেছে বিএনপি। কিন্তু কেন্দ্রের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে দলটির মাঠ পর্যায়ের শতাধিক নেতাকর্মী ইতোমধ্যেই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যাদের পরে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৮ মে অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ৭৯ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। বহিষ্কার করার আগে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে, এমনকি সরাসরি কথা বলেও থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। উল্টো আগামী ২১ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বিএনপির আরও অন্তত ৬১ নেতাকর্মী প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সপ্তাহখানেক আগে তাদেরও বহিষ্কার করা হয়েছে।
জাতে-পদে বিএনপি আর জাপা একই গোত্রভুক্ত। উভয় দলের গঠন প্রণালি প্রায় একই। কিছুটা ভিন্নতা কেবল স্বভাবে আর কৌশলে। উপজেলা নির্বাচনে এসে গুণবিচারে বিএনপির চেয়ে আরও নাজুক দশা জাতীয় পার্টির। বিএনপি বরাবরই উপজেলা পদ্ধতির বিরুদ্ধে। ক্ষমতা ও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ধুয়া তুলে এরশাদের আরোপ করা এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে আশির দশকে তীব্র আন্দোলন করেছে বিএনপি। এরশাদ পতনের পর একানব্বই সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি উপজেলা পদ্ধতি বাতিলই করে দেয়। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, উপজেলা পদ্ধতির প্রবর্তনকারী জাতীয় পার্টিও এবারের উপজেলা নির্বাচনে নেই। জিএম কাদের এবং রওশন দুই গ্রুপই এ নির্বাচন বয়কট করেছে। অথচ ঘোষণা ছিল এ নির্বাচনে লড়ার। প্রস্তুতি নিয়ে প্রার্থী খুঁজেছে। কোনোরকমে বলেকয়ে জাপার রাজধানী রংপুরে পাঁচটিসহ দিনাজপুর, নরসিংদী, খাগড়াছড়ি, বরিশাল মিলিয়ে জনাদশেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হাত করতে পেরেছিল জাপা। তারাও এখন ডুব দিয়েছে।
মাঠের ও দলের নমুনা দেখে তারা চ¤পট দেওয়ার মতো সরে পড়েছেন। আছেন গা-ঢাকা দেওয়ার মতো। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। ফোনও ধরছেন না। সংসদ নির্বাচনের মতো ১১ কেন, উপজেলায় এক সিটেও ক্ষমতাসীন দল তাদের রিলিফ দেবে না, সেই বার্তা জাপা পেয়ে গেছে। তাদের দলের মাঠের নেতারাও হিসাবে পাকা। জামানত হারানোর ভয়ে তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। উপজেলায় অপমানের চেয়ে গরহাজির থাকার পথে জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া দলের তৃণমূলের নেতারা এমনিতেই অভিভাবকহীনতা নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে কাহিল। তার ওপর উপজেলা নির্বাচনে খরচ টানার বিষয়। দল থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন করার মতো টাকা নেই তাদের প্রার্থীদের।
এসবের মধ্য দিয়ে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভেতরের করুণ দশা আর লুকানোর মতো নয়। ঘুরে দাঁড়ানোর পুঁজিও নেই। মুখে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলা হলেও ভেতরে ভেতরে দলটি চল্লিশা-জেয়াফতের পথে। এ পর্যন্ত ৫-৬ দফা ভাঙতে ভাঙতে দেবর-ভাবিতে এসে ভাঙনটি জাতীয় পার্টিকে বিলুপ্তির সন্ধিক্ষণে নিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীনরা জাপার মধ্যে এখন আর কোনো রস-মধু দেখছে না। আবার সময় হলে যে কোনো সময় বিনা নজরানাতেই জাপাকে ব্যবহারের দাওয়াই সরকারের জানা। সরকারের বিরুদ্ধে জাপার বিভিন্ন অংশের নেতাদের হুমকি-ধমকির ওজনও সরকার বোঝে। কদিন আগে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের জেলা নেতারা ঢাকা এসে সারাদেশে জাতীয় পার্টির করুণ দশার কথা জানিয়ে গেছেন। এই করুণ দশা থেকে বেরিয়ে আসতে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে বউয়ের কথা না শোনার পরামর্শ দিয়েছেন। আর মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে বলেছেন, বনানী কার্যালয়ে বসে গুটি চালাচালি বন্ধ করতে। কিন্তু সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও নেতাদের এ ছকের বাইরে যাওয়ার অবস্থা নেই।
সরকারের বিরোধিতায় নেমে মাঠ গরম করার রসদ নেই দলটির। আবার রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির লেজ ধরার দাওয়াত নেই। মহাজোট-চৌদ্দ দলে মার্জ করার ক্রেডিবিলিটি শেষ হয়ে গেছে সেই কবেই। তার ওপর প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টির মূল নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে, তা এখনো আদালতের এখতিয়ারে। হালে মূল জাতীয় পার্টি কোনটিÑ এ প্রশ্ন তো রয়েছেই। দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে সংসদে থাকাসহ নানা কারণে দেবরের হাতে থাকা অংশকে মূল জাপা বলে ট্রিটমেন্ট দেয় গণমাধ্যমগুলোও। নিজস্ব মাঠে এই বিরোধী দলের বিরোধী দল রওশন এরশাদের জাপা। গণমাধ্যম সেটিকে চিহ্ন দিচ্ছে রওশনপন্থি জাপা নামে। মাঠে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপায় দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি নেই বললেই চলে। কর্মসূচির দৌড়ে এগিয়ে আছে রওশনের জাতীয় পার্টি। রাজনীতিতে যা কেবলই বিনোদন আইটেম।
গত তিন-চার মেয়াদ ধরে আওয়ামী লীগের অনুক¤পায় সংসদে থেকেছে, ক্ষমতার অংশীজনও হয়েছে। পরে আবার বোঝাপড়ায় বিরোধী দলও হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে গৃহপালিত-আজ্ঞাবহ ইত্যাদিতে ভূষিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের হালখাতা থেকে ছিটকে পড়তে পড়তে এখন জাতীয় পার্টি কেবলই একটি ভাবি-দেবর-স্ত্রী-সন্তানদের ফোরাম মাত্র। বাকিরা কেবল কোনো না কোনো ফোরামের খাদেম বা মুরিদ। তাও অস্থির-অস্থায়ী। সকালে এদিকে, সন্ধ্যায় আরেকদিকে। বিএনপিতে এখনো একদম এমন না হলেও মা-ছেলেতেই ঘুরছে দলটি। পল্টন-গুলশান-লন্ডন ত্রিভুজের মাঝে বিএনপিতে কোনো না কোনো দেশের বিশেষ করে পশ্চিমা কূটনীতিকরা ফ্যাক্টর হয়ে যাচ্ছেন। দলের নেতাদের কেউ কেউ তখন মা-ছেলেকে না ছাড়লেও ফরেন কানেকশনের লেজ খোঁজেন। লেজ আর মগজ তালাশের এ চক্করে লেজেগোবরে দশা বিরোধী দলের রাজনীতি। যা রাজনৈতিকভাবে সরকারকে করছে আরও নির্ভার। ড্যামকেয়ার, বেপরোয়াও।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন