সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে সচেতন নাগরিক কমিটি। শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগের বিষয়টি জানানো হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে (টিআইবি)’র অনুপ্রেরণায় গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বিবৃতিতে উল্লেখ করে, সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমা ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এ কারণে সময় আরও ৭দিন বাড়ানো হয়। কিন্তু আমরা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে (টিআইবি)’র অনুপ্রেরণায় গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), সুনামগঞ্জ গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সময় বাড়িয়েও বাঁধের কাজ শেষ করা যায়নি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, বাঁধ নির্মাণে যুক্ত সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির এখানে দায় রয়েছে।
সুনামগঞ্জের কৃষকেরা হাওরের বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। কৃষক পরিবারের সব ধরনের ব্যয় হাওরে উৎপাদিত বোরো ধান থেকে আসে। তাই কোনো কারণে এই ফসল তাদের গোলায় না তুলতে পারলে কৃষক পরিবারে কষ্টের সীমা থাকে না। সরকার প্রতি বছর হাওরের ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বাঁধের কাজটি যাতে যথাযথভাবে এবং নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয় এ জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সঙ্গে এই কাজে ২০১৭ সালের পর থেকে সরাসরি জেলা প্রশাসনকে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব এবং যথা সময়ে কাজ শুরু করতে না পারার কারণেই কাজটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায় না বলে অনেকেই মনে করেন। জেলায় কৃষকদের পক্ষে সোচ্চার ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তি বাঁধ নির্মাণ কাজে বিভিন্ন সময়ে অনিয়ম, গাফিলতির অভিযোগ তুলেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন নিয়েই অভিযোগ থাকে বেশি। এসব অভিযোগ কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখলে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে প্রায় প্রতি বছর বাঁধের কাজে এমনটি হত না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, এ বছর জেলায় ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হচ্ছে। এতে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। প্রকল্প রয়েছে ৭৩৫টি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুয়ায়ী, এখনো অনেক স্থানে বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে সময় বাড়িয়ে লাভ কী হলো। আমাদের দাবি হচ্ছে, যারাই কাজে অনিয়ম, অবহেলায় যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। একই সঙ্গে কাজে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সনাকের পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধি (সনাক সদস্য) বৃহস্পতিবার জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের ৯টি প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, এসব প্রকল্পের মধ্যে যেগুলো উপজেলার সদরের কাছাকাছি সেগুলোর মাটির কাজ শেষ হয়েছে। উপজেলার সদরের কাছাকাছি থাকার কারণেই এসব প্রকল্পে প্রয়োজনীয় তদারকি ছিল, এ কারণেই কাজ যথাযথভাবে করতে বাধ্য হয়েছেন পিআইসির লোকজন। কিন্তু দুর্গম হাওরের কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়েছে চলতি মাসে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরও ১০ দিন লাগবে বলে স্থানীয় কৃষকেরা জানিয়েছেন। প্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও প্রকল্প এলাকায় দুটি ছাড়া বাকিগুলোতে পিআইসির লোকজনকে পাওয়া যায়নি। কাজের দেখাশোনা করছেন ‘সাব ঠিকাদারেরা’।
বৌলাই নদীর উত্তরপাড়ে রতনশ্রী গ্রাম থেকে ২৬ নম্বর প্রকল্পের শুরু। এই প্রকল্পের মাটির কাজ প্রায় শেষ। বাঁধে ঘাস লাগানো হয়েছে। ২৭ নম্বর প্রকল্পে মাটির কাজ শেষ হলেও সব স্থানে ঘাস লাগানো বা দুর্মুজ করা হয়নি। মোটামুটি ২৮, ২৯ ও ৩০ নম্বর প্রকল্পের অবস্থা একই রকম। হাওরের পোগাপোড়ার গোপ এলাকায় ৩১ ও ৩২ নম্বর প্রকল্পের মাঝখানটায় মাটি ফেলা হচ্ছিল ট্রাক দিয়ে। এখন কেন মাটি ফেলছেন জানতে চাইলে ৩১ নম্বর পিআইসির সভাপতি তাজিমুল হক বলেন, তারা নাকি আগেই কাজ শেষ করেছেন। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে আরও মাটি ফেলতে হবে। এ কারণে আরও দুয়েকদিন লাগবে কাজ শেষ করতে। এই হাওরের দুর্গম এলাকা পুটিমারায় গিয়ে দেখা যায় ৩৩ ও ৩৪ নম্বর প্রকল্পে এলোমলোভাবে স্তূপাকারে মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। কয়েকটি ট্রাকে মাটি ফেলা হচ্ছে। হাওরের জমিতে ধান গাছের চারা পরিচর্চায় থাকা দুজন কৃষক জানালেন, এই দুটো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ১ মার্চ থেকে। মাটি ফেলা, মাটি শক্ত করা, ঘাস লাগানোতে আরও কমপক্ষে ১০দিন সময় লাগবে। কেন এত পরে কাজ, এমন প্রশ্নে পিআইসির প্রতিনিধি সায়েদ মিয়া বলেন, মাঝখানে বৃষ্টি হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ কাজ করতে পারেননি তাঁরা। তাই কাজে বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু এর আগের আড়াইমাস কি করলেন? এটির কোনো জবাব ছিলনা তাঁর কাছে। একটি হাওরের যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অন্য হাওরের চিত্র যে প্রায় একই রকম হবে সেটি সহজেই অনুমেয়।
আমরা মনে করি বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই সব কাজ দ্রুত শেষ করা দরকার। কারণ, বৃষ্টির সময়ে কাজ হলে সেই বাঁধ দুর্বল হয়। আর দুর্বল বাঁধ উজানের পাহাড়ি ঢলের চাপ সামলাতে পারে না। আমরা কৃষকেরা কান্না চাই না, কৃষকের মুখে হাসি দেখতে চাই। আশা করি প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সম্মিলতিভাবে এ জন্য উদ্যোগী হবেন। একই সঙ্গে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করবেন।