শহীদনূর আহমেদ ::
পাকিস্তানী ক্যাম্পে খাবার না দেয়ায় বাবাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হানাদারবাহিনী। বাবার নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে ঘরে নতুন বউ রেখে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন ছেলে। জীবনবাজি রেখে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করে দেশের সংগ্রামে অবদান রাখলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও স্বীকৃতি মেলেনি এই অকুতোভয় বীরযোদ্ধার। বলছিলাম সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. হাছন আলীর কথা।
হাছন আলীর বয়স এখন ৭৬-এর কোঠায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ছিলেন টগবগে যুবক। যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি ক্যাম্পে খাবার দিতে রাজি না হওয়ায় বাবা মফিজ উদ্দিন মুন্সিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হানাদারবাহিনী। সেখানে রাতভর নির্যাতন চলে মফিজ উদ্দিন মুন্সির ওপর। পরদিন সকালে স্থানীয় এক রাজাকারের সহযোগিতায় চাল আর খাসির বিনিময়ে বাবাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন হাছন আলী। এ ঘটনার পর থেকে বদলে যান হাছন আলী। প্রতিশোধের স্পৃহা জাগে তার মনে। বাবাকে নির্যাতনের প্রতিশোধ আর দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সদ্য বিয়ে করা বউ রেখে চলে যান মেঘালয় সীমান্তের অপারে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে যোগদেন মুক্তিযুদ্ধে। বালাট সাবসেক্টরের বি কোম্পানি কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে ভারতীয় সীমান্তবর্তী সদর উপজেলার একাধিক যুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অস্ত্র জমা দিলে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র প্রাপ্ত হন হাছন আলী। দেশ স্বাধীনের পর নিরক্ষর হাছন আলী জীবিকার খোঁজে চলে যান অন্যত্র। তাই বঞ্চিত হন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তি থেকে। বঞ্চিত হন সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধাসহ স্বীকৃতি থেকেও। স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপের শেষ নেই হাছন আলীর।
জীবন সায়াহ্নে আসা হাছন আলী জানান, যুদ্ধ গিয়েছিলাম বাবার নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। তিন মাসের উপরে যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম। দেশ স্বাধীনের পর কয়েক বছর সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সহায়তা পেয়েছি। এক পর্যায়ে অভাবের তাড়নায় জেলার বাইরে চলে গিয়েছিলাম। আগে মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কদর ছিলনা। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয় তখন এলাকার দুয়েকজন জানাশোনা মুক্তিযোদ্ধার সাহায্য চেয়েও কাজ হয়নি। মুর্খ মানুষ অফিস-আদালতেও যেতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকগুলো কাগজপত্র ছিল। ৮৮ বন্যায় তা নষ্ট হয়েগেছে। কেবল ওসমানী সাহেবের সার্টিফিকেট আছে আমার কাছে।
এদিকে হাছন আলীর জীবনের পড়ন্তবেলা কাটছে অবহেলা আর অযতেœ। সন্তানদের কুঁড়ঘরে মাথাগোঁজার ঠাঁই হলেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হাছন আলী। ৫ শতকের একটি ভিটা ছাড়া কোনো জমিও নেই তার। ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের বড় পরিবারে টানাপোড়েন লেগেই থাকে। নিজেও ভুগছেন বার্ধক্যজনিত নানা রোগে।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখলেও ৫৩ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না পাওয়ায় হতাশা জানিয়ে হাছন আলীর স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, যুদ্ধের সময় আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আমাকে ঘরে রেখেই আমার স্বামী যুদ্ধে গিয়েছিলেন। আমার স্বামী একজন মুক্তিযোদ্ধা তা এলাকার সবাই জানে। কিন্তু সরকারের তালিকায় তাঁর নাম নেই। আমাদের ভাতার প্রয়োজন নাই। আমার স্বামী যাঁতে মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন এটাই আমাদের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের অধীনে সুনামগঞ্জের ৪টি সাবসেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্টদের অবহেলা আর উদাসীনতায় তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ছলিমুল্লাহ বলেন, আমাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে।
হাছন আলীর মতো স্বীকৃতিহীন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ বলেন, জামুকা বিগত সময়ে মুক্তিযোদ্ধার হালনাগাদ করেছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা আর উদাসীনতার কারণে কিছু রাজাকার আলবদর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। এটা আমাদের জন্য অনেক লজ্জার। প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়েছেন। প্রকৃত এসব মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রলায় উদ্যোগী হবেন এমনটাই মনে করি।