শামস শামীম ::
সুনামগঞ্জের ৫টি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে চোরাইপথে নানা পণ্য আনছে একাধিক সিন্ডিকেট। নির্দিষ্ট দিনে জেলার তিনটি সীমান্ত হাট দিয়েও এসব পণ্য আসছে। চোরাচালানের পণ্য পাচার করতে গড়ে ওঠেছে রাজনৈতিক, পেশাজীবী সিন্ডিকেট। ‘উন্মুক্ত চোরাচালান’ নিয়ে জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায়ও একাধিক আলোচনা হয়েছে। সীমান্তের ৫ কিলোমিটার এলাকার লোকের জন্য খুচরো বিকিকিনির লক্ষ্যে সীমান্ত হাট চালু হলেও এই সুবিধা ভোগ করছে ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। তাই হাটে খুচরো বিকিকিনি না হওয়ায় বাজারের লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। বাণিজ্য ভারসাম্য নীতি প্রতিফলিত হচ্ছেনা বলে মনে করেন সুধীজন। তাছাড়া সীমান্তের ১৩টি ইউনিয়নে ‘মানবপাচার ও চোরাচালান প্রতিরোধ কমিটি’র প্রভাবশালীরাও পাচারে যুক্ত হয়ে পড়ায় চোরাচালান আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
সুনামগঞ্জে ১২০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা আছে। সুনামগঞ্জ সদর, দোয়ারাবাজার ও তাহিরপুর উপজেলায় রয়েছে তিনটি সীমান্ত হাট। খুচরোর বদলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পাইকারি দরে পণ্যের চালান নিয়ে আসে হাট দিয়ে। বর্ডার হাটের বাইরেও সীমান্ত এলাকার কাঁটাতার কেটে বিভিন্ন পয়েন্টে চোরাই মালামাল পাচারে বিশেষ পকেট করে নিয়েছে। কাঁটাতার ডিঙিয়ে গবাদিপশু, প্রসাধনী, গরম মশলা, কাপড়, পেঁয়াজ, চিনি, আপেল, আঙ্গুর, কমলা, মাল্টাসহ চোরাই পণ্য নামছেই।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সীমান্ত এলাকার কিছু জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক অসাধু নেতাকর্মীসহ জেলা শহরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত একটি গোষ্ঠীকে দিয়ে ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে চালান নিয়ে আসে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কমিশন নিয়ে এসব পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মালবাহী কার্গো ট্রাকে পাচার করতে এলাকা ভাগ করে নিরাপদে পৌঁছে দিতে কাজ করছে আরো কয়েকটি সিন্ডিকেট। সবাইকে ম্যানেজ করেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বিনাশুল্কে ভারত থেকে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আনছে অবাধে। মাঝে-মধ্যে কমিশন নিয়ে ঝামেলা হলে বা, পেশাজীবীদের কমিশন না দিলেই একপক্ষ আরেকপক্ষকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করে। তখন বিষয়টি প্রকাশ্যে আসলে আইন-শৃৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাতে বাধ্য হয়।
সরেজমিন কয়েকটি সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন বিকেল হলেই পাচারকারী সিন্ডিকেট স্থানীয় শ্রমিকদের ব্যবহার করে সীমান্ত থেকে বস্তা ও কার্টনে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য নামাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার কিছু পুলিশ, সীমান্ত ফাঁড়ির কিছু বিজিবি সদস্য ছোট ছোট গাড়িতে এগুলো বড়ো কার্গো জাহাজ পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছতে বাধা দেননা বলে অভিযোগ আছে। কার্গোতে এসব পণ্য উত্তোলনের পরে কিছু প্রভাবশালী নেতা, কিছু রাজনৈতিক ক্যাডার এসব পণ্য ভর্তি কার্গো সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। গবাদিপশুগুলো স্থানীয় সীমান্ত এলাকায় যেসব পশুর হাট রয়েছে সেই হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সহজেই বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তের একাংশের পণ্য নদীপথে নেত্রকোণা-কলমাকান্দা হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়। মধ্যনগর সীমান্ত এলাকার পণ্যও নৌকা ও গাড়িতে করে মোহনগঞ্জ নেত্রকোণা হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরের তেকুইন্যা বিল দিয়েও এসব পণ্য নৌকায় পাচার হচ্ছে। বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্ত দিয়ে নামা অবৈধ পণ্য সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক হয়ে ট্রাক-কার্গো ট্রাকে পাচার হয়। সিলেটের পেঁয়াজ-চিনিসহ মনোহারি ব্যবসায়ী কিছু নেতাও এই কাজে যুক্ত আছেন। এই সিন্ডিকেটে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু বড় আড়তদারও জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ সদরের চোরাই মালামাল আব্দুজ জহুর সেতু দিয়ে রাত ১২টার পর পাচার শুরু হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রায় সোয়া কোটি টাকার পেঁয়াজ আটক হয়েছিল। এসময় ট্রাকের ড্রাইভার ও হেল্পারদের মধ্যে যাদের আটক করা হয়েছে তারা বগুড়া, নড়াইল, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের। গত ১২ মার্চ টাঙ্গুয়ার হাওরের তেকুইন্যা বিলে অভিযান চালিয়ে চিনি, পেঁয়াজসহ কয়েকটি নৌকা জব্দ করে মধ্যনগর থানা পুলিশ।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন আব্দুজ জহুর সেতু দিয়ে অন্তত ১০০ ট্রাক ও মালবাহী কার্গো ট্রাক রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত চোরাই পণ্য পরিবহন করে। তখন সিন্ডিকেটের হয়ে নিজ নিজ পরিবহনগুলো আগে পিছে থেকে সহজে বের করে দিতে কাজ করে রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মীসহ শহরের কিছু ক্যাডার।
ব্যবসায়ীরা জানান, ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে আমদানি বন্ধ আছে। এই সুযোগে ভারত থেকে চোরাই পথে সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আসছে বলে কাঁচাপণ্যের আড়তদার সমিতির নেতারাও স্বীকার করেছেন। কয়েক হাত ঘুরে এসব পণ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামেও পৌঁছে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের অন্তত ১০-১২টি আড়তে চোরাইপথে নিয়ে আসা এসব পণ্য বিক্রির প্রমাণ মিলেছে।
এদিকে আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, যেসব পণ্য জব্দ করে নিলামে তোলা হয় আরেকটি সিন্ডিকেট কিনে নিয়ে মূল সিন্ডিকেটের হাতেই তুলে দিয়ে তারাও কিছু কমিশন হাতিয়ে নিচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ অভিযানে পাচার হয়ে আসা সুনামগঞ্জে ১৯২ দশমিক ৯ টন চিনি জব্দ করা হয়েছিল। তবে এই পরিমাণ অন্তত ৮০ গুণ বেশি হবে বলে জানা গেছে সাধারণের ধারণা।
চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ায় সর্বশেষ গত ১০ মার্চ জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিলতা রয়েছে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন পাবলিক প্রসিকিউটর ড. খায়রুল কবির রোমেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর ড. খায়রুল কবির রোমেন বলেন, সীমান্তে চোরাচালান ওপেন হয়ে গেছে। বর্ডারহাটকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে চোরাচালান বৃদ্ধি পেলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নীরব রয়েছে। আমি আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এসব বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রস্তাব করেছি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রাজন কুমার দাস বলেন, এই চোরাচালানে বাইরের জেলার চোরাকারবারিদের সম্পৃক্ততা এড়ানো যায়না। কারণ ট্রাকসহ যাদের আটক করা হয়েছে তারা বাইরের জেলার। পুলিশ ব্যবস্থা নেয়না বা নীরব থাকে এটা ভুয়া কথা। আমরা খবর পেলেই ব্যবস্থা নেই।
জেলা প্রশাসক ও জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, আইন-শৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বিজিবি ও পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছি।