1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২১ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাঁচাবে কে? : আমীন আল রশীদ

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০২৪

বছর কয়েক আগে গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন তুলেছিলেন: বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? এই প্রশ্নটি তিনি তুলেছিলেন কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে অনিয়মের সংবাদ তৈরি করতে গিয়ে ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিশেষ করে তৎকালীন উপাচার্যের রোষানলে পড়েছিলেন। তিনি এমন এক সময়ে প্রশ্নটি তুলেছিলেন যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে চাঁদা দেওয়া এবং উপাচার্যের পরিবারের লোকজনের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম ছিল। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী – ২০১৯ সালে উত্থাপিত সেই প্রশ্নের সুরাহা বোধ হয় এখনও হয়নি। বরং সাম্প্রতিক নানা ঘটনায় যে প্রশ্নটি নতুন করে সামনে আসছে সেটি হলো: বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে কী?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকা আত্মহত্যা করার পর ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে এসে গেছে কয়েক দিন ধরে। শিক্ষক থেকে উপাচার্য পর্যন্ত প্রায় সবাই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি, প্রকল্পের নামে টাকা-পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি শব্দগুলো যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমার্থক হয়ে গেছে। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতির হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাবে কে?
কয়েকটি সংবাদ শিরোনামে চোখ বুলানো যাক:
১. জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহত্যা: সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও শিক্ষক দ্বীন ইসলাম গ্রেপ্তার। ২. যৌন নিপীড়ন: জগন্নাথ শিক্ষক শাহেদ ইমন বরখাস্ত। ৩. স্বামীকে আটকে রেখে নারীকে ধর্ষণ: জাবির ছাত্রলীগ নেতাসহ ৪ জন কারাগারে। ৪. দুই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে শোকজ। ৫. ছলচাতুরীর মাধ্যমে ইনক্রিমেন্ট নিচ্ছেন কুবি উপাচার্য!
অনলাইনে সার্চ দিলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও এমন অনেক সংবাদ পাওয়া যাবে, যা পড়লে সেই পুরনো প্রশ্নই সামনে আসবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী এবং এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হচ্ছে? জনমনে এই প্রশ্নও উঠতে বাধ্য যে, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন। কোন যোগ্যতায়। কোন মানদ-ে?
এবারের আলোচনার কেন্দ্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। অবন্তিকা নামে একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার আগে যে সুইসাইড নোট লিখে গেছেন, সেখানে তিনি প্রক্টর এবং একজন সহপাঠীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও ক্ষমতার দাপট দেখানোর অভিযোগ করে গেছেন। যদিও এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, অবন্তিকার বিরুদ্ধে তার একাধিক সহপাঠীর অভিযোগ ছিল এবং এ নিয়ে থানায় জিডিও করা হয়েছিল। তবে প্রকৃত ঘটনা কী সেটি নিশ্চয়ই তদন্তে বেরিয়ে আসবে। এরই মধ্যে অভিযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হয়েছেন।
একই সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে একজন শিক্ষককে বরখাস্ত এবং আরেকজনককে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের একজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, তার কোর্স শিক্ষক তাকে অ্যাকাডেমিক কাজে নিজের কক্ষে ডেকে ‘যৌন হয়রানি’ করেন।
এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করায় বিভাগের চেয়ারম্যান তাকে ‘ফেল করিয়ে দেন’। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ওই শিক্ষার্থী মৌখিক পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, মৌখিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী কী করে শূন্য পেলেন? যত কম মেধাবীই হোন না কেন, মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে তার শূন্য পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তার মানে তাকে শূন্য দেয়া হয়েছে প্রতিহিংসাবশত। প্রতিকার দাবি করছেন ওই শিক্ষার্থীটি, বিচারের আশায় রাষ্ট্রপতির কাছেও চিঠি লিখেছেন।
প্রশ্ন হলো, একজন শিক্ষক বা একজন বিভাগীয় চেয়ারম্যান তার বা তাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীর প্রতি কি এতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারেন? পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশের কোনো সভ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি কি কল্পনাও করা যায়? শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কি এতটা বৈরি হতে পারে যে মৌখিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীকে শূন্য দিতে হবে কিংবা শিক্ষকের আচরণ কি এতটা ভয়াবহ হতে পারে যে একজন শিক্ষার্থীকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিতে হলো?
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ফেসবুকে লিখেছেন: “আসলে আমাদের শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটাই পচা গলা। কেবল একটি মৌখিক পরীক্ষা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়। ১৫-২০ মিনিটের একটা ইন্টারভিউ-ই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র প্রক্রিয়া হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে পারে বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য অযোগ্য, দলান্ধ মুর্খ শিক্ষক শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়েছে। শিক্ষক নিয়োগ এখন মাফিয়া তন্ত্রের হাতে বন্দি।”
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যখন এত এত অভিযোগ; বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়ানো হয়, কী শেখানো হয়, কারা সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, কোন যোগ্যতায় পান, কারা উপাচার্য ও প্রক্টর হন এবং কোন যোগ্যতায় হন – যখন এইসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই, তখন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ। গত কয়েক বছর ধরেই সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা সংসদে এবং সংসদের বাইরে বারবার বলেছেন যে, প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে।
এ স¤পর্কিত কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম:
১. আরও ছয় জেলায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ, মত দিল ইউজিসি। ২. প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিটি বিভাগে একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা: শিক্ষামন্ত্রী। ৩. প্রত্যেকটি জেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে: নওফেল। ৪. কসবা-আখাউড়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা আইনমন্ত্রীর।
খবরগুলো ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় কাগজে প্রকাশিত।
বস্তুত একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় একেকটি প্রকল্প। অবকাঠামো প্রকল্প। বিরাট জমি অধিগ্রহণ। অধিগ্রহণের আগে থেকেই চলে সেখানে ব্যবসার প্রস্তুতি। অধিগ্রহণকৃত জমির মালিক কত পাবেন, যারা জমি কেনায় মধ্যস্থতা করলেন তারা কত পাবেন, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের অংশ কত – এসব ঠিক হয়ে যায় প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর আগেই। তারপর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কত টাকার প্রকল্প কে ঠিকাদার, কে নির্মাণ সামগ্রীর সরবরাহকারী, কার কত ভাগ ইত্যাদি।
অবকাঠামো নির্মাণ চলাকালীনই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু। কারা নিয়োগ পাবেন, কোন কোন বিবেচনা সেখানে কাজ করবে, কোন পদের বিপরীতে কত টাকা ঘুষ নেয়া হবে – এসব নিয়ে চলে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। আবার বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়ে যাওয়ার পরেও একের পর এক প্রকল্প। অর্থাৎ পুরো বিষয়টাই টাকা-পয়সার খেলা। এখানে জাতিকে উচ্চশিক্ষিত করা, শিক্ষার মান বাড়ানো, নিত্য নতুন বিষয়ে গবেষণা করা মুখ্য বিষয় নয়। দলীয় লোকদের চাকরি এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রকল্প। অথচ বাংলাদেশের মতো আয়তনে ছোট্ট একটি দেশে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটিই যে হাস্যকর, অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয় – এই কথাটিও জোর দিয়ে কেউ বলছেন না। বলতে পারছেন না। বরং সবাই একই সুরে কথা বলতে অভ্যস্ত।
স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগে ‘গ্রাম হবে শহর’ – এরকম একটি উদ্ভট আইডিয়া নিয়েও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বেশ সরব হয়েছিলেন। নদী, সবুজ প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত উর্বর জমির কারণে কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলাই যে প্রকৃত বাংলাদেশ এবং গ্রামই যে বাংলাদেশের শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক; পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশ থেকে কৃষিনির্ভর সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ যে একটি ইউনিক রাষ্ট্র – সেই বোধটুকু নীতিনির্ধাকরদের মাথায় থাকলে তারা গ্রামকে শহরে বানানোর কথা বলতেন না। বরং গ্রামের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখে মানুষের জীনব মান উন্নত করার কথা বলতেন।
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসেপ্ট বা ধারণা ও দর্শন স¤পর্কে ধারণা নেই বলেই এখন তারা বলছেন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কেন জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে? জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, চিন্তাশীল জনগোষ্ঠী তৈরি, নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নের জন্য দক্ষ মানবস¤পদ গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন আছে? বরং যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন রয়েছে, সেগুলো প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারছে কি না; না পারলে তার সংকটগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর দ্রুত সমাধান করাই যৌক্তিক।
শুধু বড় বড় ইমারত গড়ে তুলে উন্নয়ন দেখানো যায় বটে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি ওই প্রতিষ্ঠানগুলোয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা; নতুন জ্ঞান সৃষ্টি; পুরনো ধ্যান ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহসী, চিন্তাশীল ও মেধাবী জনগোষ্ঠী তৈরি; মানবজাতির উন্নয়নে নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা; একটি গণতান্ত্রিক-পরমতসহিষ্ণু সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারছে কি না – সেটি বিরাট প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের সুরাহা করতে না পারলে অবন্তিকাদের স্বেচ্ছামৃত্যু আর কিছু শিক্ষকের গ্রেপ্তার কিংবা চাকরিচ্যুতি অব্যাহত রাখতে হবে। দিন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাকা কামানো আর ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্র হিসেবেই বিবেচিত হবে।
তাহলে সমাধান কী এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাঁচাবে কে? সহজ উত্তর রাজনীতি। রাজনীতি ঠিক থাকলে দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ঠিক হয়ে যেতে বাধ্য। প্রকৃত ও জনবান্ধব এবং সহনশীল রাজনীতি ও রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকলে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় সংগঠনে পরিণত হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তখন দলীয় ক্যাডারের ভাষায় কথা বলেন। সুতরাং এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যা হচ্ছে সেটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com