সংবাদশিরোনামটা সত্যি অদ্ভুত। এতোটই অদ্ভুত যে, সত্যি ভূত দেখার মতো চমকে না উঠে কোনও উপায় নেই। শিরোনামটা, ‘হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা পিটালো মুক্তিযুদ্ধের সংগঠককে’। অথচ ওই পিটুনী খাওয়া রোগীর বয়স ৭৯ বছর, একাধারে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুড়খাওয়া বামপন্থী নেতা এবং সর্বোপরি একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ রাজাকারদের অত্যাচারের বিচার প্রত্যাশী আন্দোলক। এমন লোকের প্রতি ডাক্তার-নার্সরা ক্ষিপ্ত হলেন কেন সেটা বোধগম্য নয়।
যে-অভিযোগে তাঁকে লাঞ্ছিত করা হলো, তার বিবরণটা এরকম, ‘তবে তিনি (অমর চাঁন) কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এক নারী চিকিৎসকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছেন, যা সভ্য মানুষ করতে পারেন না।’ এবংবিধ আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে পিটুনীর ঘটনাটি সংঘটিত হয়।
সংবাদবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘পুরুষ চিকিৎসকটি কমরেড অমর চাঁনকে ‘তুইতোকারি’ করে কথা বলার পাশাপাশি খারাপ আচরণ করতে থাকেন। তাকে কিলঘুষিও দেন। রাত দেড়টার দিকে অমর চাঁনকে ওই পুরুষ চিকিৎসক পাঁজাকোলা করে শয্যা থেকে চিকিৎসকের কক্ষের পাশে উঠিয়ে’ নিয়ে গেলে সেখানে ‘১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল তাঁকে কিলঘুষি মারতে থাকে।’
বৃদ্ধ অমর চাঁন দাস ‘কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে’ এমন কী ‘খারাপ ব্যবহার’ করলেন যে, ১০/১৫ জন ডাক্তার মিলে তাঁকে এমনভাবে মারধর করতে হবে? আর ‘নারী চিকিৎসকের সঙ্গে অশালীন আচরণ’? সেটা তো বৃদ্ধ বয়সে অমর চাঁনের পক্ষে কল্পনাতীত। বাস্তবে যদি অমর চাঁনের আচরণ এমনটাই হয়ে থাকে তার ব্যাখ্যা কী? ‘কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার’-এর পরে ‘নারী চিকিৎসকের সঙ্গে অশালীন আচরণ’ এই উভয়বিধ আচরণই বৃদ্ধ অমর চাঁনের ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই একটি অসুস্থতা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ সুস্থ অমর চাঁনের পক্ষে এমন বিবেকবর্জিত আচরণ করা কীছুতেই সম্ভব নয়। অমর চাঁনকে ব্যক্তিগতভাবে যাঁরাই জানেন তেমনটাই তাঁরা বলবেন।
তাই প্রশ্ন হলো, চিকিৎসকরা কেন তাঁর চিকিৎসা না করে তাঁকে মারধর করে হাসপাতালকে সন্ত্রাসীদের আখড়া বানিয়ে দিলেন? এর অন্য কোন সমাধান কি ছিল না? তাঁরা আইন হাতে তোলে নিলেন কেন? প্রতিকার হিসেবে কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলো না কেন? কোনও রোগীর অসদাচরণের প্রতিকার কি হাসপাতালে ডাক্তর-নার্স মিলে রোগীকে মারধর করা? বুঝাই যায়, ডাল মে কোচ কলা হায়।
আরও বুঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের হাসপাতাল জানে না যে, হাসপাতাল-ডাক্তার-নার্স তৈরি করা হয়েছে অমর চাঁনদের মতো কোটি মানুষের পকেটের টাকায় তাঁদের চিকিৎসার জন্য। ভুলে গেলে চলবে না, হাসপাতাল রোগীকে মারধর করার জন্য নয়, চিকিৎসা দিয়ে নিরাময়ের জন্যÑ রোগী যতো খারাপ আচরণই করুক না কেন? অমর চাঁনের অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ডাক্তারদের সন্ত্রাসী আচরণে কাপুরুষতার নিহিতার্থ কী? সেটা কি এই যে, হাসপাতালের চিকিৎসাসেবাকে কোনও না কোনভাবে দামি পণ্যে রূপান্তর করে ফেলা হয়েছে। তা-না হলে হাসপাতালে এমন অসম্ভব ঘটনা ঘটবে কেন? হাসপাতালে রোগীর পক্ষে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ব্যাকুলতা জনিত একটু আধটু অধিকার ফলানোর মতো আবেদন জানানো কি রোগীর পক্ষে শাস্তিযোগ্য অপরাধ? যে অপরাধ নিশ্চিত করবেন ১০/১৫ জন ডাক্তার মিলে ৭৯ বছরের বৃদ্ধ রোগীকে পেটানোর ঔষধ দিয়ে। আমরা কেবল যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে এই অন্যায়ের প্রতিকার চাই।