গত বৃহস্পতিবার (৯ জুন ২০২২ খ্রি.) রাত ৮টার দিকে রান্নাঘরের পাশের নলকূপ থেকে পানি আনতে গেলে একজন গৃহবধূ অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে দোয়ারাবাজার উপজেলায়। কে বা কারা কেন এই হামলা করেছে জানাযায় নি। এই গৃহবধূ তিন সন্তানের জননী এবং তাঁর স্বামী একজন সৌদিপ্রবাসী। রাতের নির্জনতার সুযোগে প্রহরীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সুনামগঞ্জ পৌর কলেজের মালামাল নিয়ে সটকে পড়ার একটা কারণ থাকতে পারে, চোরের টাকা চাই। এমনকি যখন হিরোসিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা ফাটানো হয় কিংবা রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে, অনুসন্ধান করলে তার কারণ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই গৃহবধূর উপর অ্যাসিড হামলার কী কারণ থাকতে পারে কীছুতেই সাধারণ বুদ্ধিতে বোধগম্য হওয়ার নয়। আমরা কেবল তাঁর উপর আক্রমণের একাধিক কারণ সম্পর্কে অনুমান করতে পারি, কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না কোন কারণে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে। আসলে কোনও কারণেই, কোনও নারী কেন, কারও উপরই এরকমভাবে অ্যাসিড আক্রমণকে কোনও যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু সমাজে এমন অদ্ভুত এবং একই সঙ্গে যারপরনাই ভয়ঙ্কর ও অমানবিক কাণ্ড ঘটেই চলেছে এবং যাঁরা ঘটাচ্ছেন তাঁরাও কেন ঘটাচ্ছেন তার যুক্তিসঙ্গত কোনও কারণদর্শাতে পারছেন না।
আসলে সমাজটা আপাদসমস্তক সম্পূর্ণটাই জবাবদিহিতার বাইরে চলে গেছে এবং প্রকারান্তরে আইনের শাসনের ভেতরেই একধরনের আইন অমান্য করার স্বাধীনতা সমাজের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছে। অর্থনীতি মানুষের চারিত্র্যলক্ষণের মূল কাঠামো তৈরির কারিগর। আমরা দেখতেই পাচ্ছি, বিদ্যমান আর্থনীতিক পরিসরের ভিত্তিতে কালো টাকা বৈধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে আইন প্রণেতা প্রতিষ্ঠান। এই করে তো যেনতেন প্রকারেÑ এমন কি মানুষ খুন করে হলেওÑ সম্পদ আহরণের প্রক্রিয়ায় আইনানুগ প্রতিরোধ তোলা সম্ভব হলো না বা হচ্ছে না। আপাতত এটাই সত্য এবং ইউক্রেইন যুদ্ধের পরিস্থিতি বিবেচনায় যেখানে এই সত্য প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, পুঁজিবাদের বিশাল বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতির কূটকৌশলের আওতায় যুদ্ধোন্মাদনাকে উৎসাহিত করাই বিশ্বরাজনীতির (এখানে বলা ভালো, বিশ্বপুঁজির কাজ) একমাত্র কাজ, সে-দিক থেকে বিবেচনায় কালো টাকাকে বৈধ করার নিয়ম তৈরির বিষয়টি একটা মামুলি ঘটনা বই অন্য কীছু নয়, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এমনিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে গ্রাম-বস্তির লোকালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান আর্থনীতিক ব্যবস্থার প্রভাব কাজ করছে এবং মানুষকে করে তুলছে অবিবেচক, অমানবিক, নির্মম ও ক্ষেত্র বিশেষে ধর্ষক কিংবা খুনি।
এমতাবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত শক্তি-প্রতিপত্তিসঞ্জাত অতৃপ্ত অহম সামান্য কারণ-অজুহাতে কিংবা একেবারেই অকারণে মানুষের উপর চটে গিয়ে নিজেকে মানবিকতা থেকে অকারণে বিচ্ছিন্ন করে তোলে সমাজের একজন হিসেবে নিজেকে সমাজের ঊর্ধ্বে প্রতিস্থাপনে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে।
হয়তো গৃহবধূর উপরে অ্যাসিড আক্রমণের কারণ এমনি আজগুবি কোনও কারণ। এবং কারণ অনুসন্ধানে নেমে অনেকেই অনেক কারণ-কথা উপস্থাপন করতে পারেন বা পারবেন, সেটাও সম্ভব। কিন্তু আমরা কেবল একটি কারণের কথাই বলতে চাই। সে-কারণটা অর্থনীতি। এই অর্থনীতির পরিসরে অনেক রকমের বৈধ-অবৈধ অন্যায় প্রশ্রয় পাচ্ছে এই সমাজ-রাষ্ট্রের পরিসরে এবং যাঁর যা ইচ্ছে করতে পারছেন নির্বিঘ্নে এবং করে কোনও না কোনওভাবে পার পেয়ে যাচ্ছেন এবং সে-জন্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের এইরকম বেপরোয়া হয়ে উঠার প্রবণতা থেকে কিংবা এইরকম ভয়ঙ্কর সমাজমানসতা থেকে সমাজকে ফেরাতে না পারলে কোনও গৃহবধূ কেন কোনও সাধারণ মানুষকেই তাদের আক্রমণের বাইরে রাখা যাবে না। রাষ্ট্র-সমাজ পরিচালকদের অবশ্যই সে-দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।