ঈদ-উল-ফিতর আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের সবচেয়ে আনন্দঘন একটি বড় উৎসব। বছর পরিক্রমায় আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে জীর্ণ কুঠির হতে রাজপ্রাসাদে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের কাছে। ঈদ সাধারণত: চান্দ্র মাসের হিসাব অনুযায়ী হিজরি সাল অনুসরণ করে পালিত হয়ে থাকে। চান্দ্র মাস যেহেতু চন্দ্র উদয় অস্তের সাথে হিসাব করা। সে জন্য রমজান মাস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একদিন আগে-পিছে শুরু হয়। ঠিক তেমনি আনন্দ আর খুশির বন্যা নিয়ে বয়ে আসা ঈদও দেশে দেশে একদিন, দুই দিন আগে-পিছে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে কিছু এলাকার মানুষ আছেন যারা সৌদি-আরবে যেদিন ঈদ হয় সেদিন তারা ঈদ উদ্যাপন করে থাকেন।
মাহে রমজান মাসে আল্লাহতালার বিধান অনুযায়ী, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তথা নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য আমরা রোজা পালন করে থাকি। রোজা শুধু সেহ্রি খেয়ে উপবাস তাকা আর সন্ধ্যায় পেটপুরে বাহারি ইফতার নয়। রোজার প্রধান অঙ্গ হলো সংযম। রোজা রাখলাম আর মানুষকে কষ্ট দেবার জন্য অবৈধভাবে জিনিষপত্রের কৃত্রিম সংকট করে মুনাফা লুটলাম, পরনিন্দা বা গীবত করলাম, মিথ্যা আশ্রয় নিয়ে মানুষকে হয়রানি করে ঘুষ খেলাম, হারাম রোজগার করে সেই উপার্জিত টাকায় ইফতার করলাম, টিভিতে অশ্লীল প্রোগ্রাম দেখে সময় কাটালাম, মানুষের ন্যায্য হক পাওনা মারলাম, নিজের স্ত্রী আর বিবাহযোগ্য মেয়েদেরকে হাইহিল জুতা আর হাতকাটা পেটকাটা জামা পরিয়ে বিভিন্ন বিপণি-বিতানে পুরুষদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ঈদের লেটেস্ট ফ্যাশনের জামা-কাপড় কিনতে পাঠালাম, পাশের বাড়ির লোক খেয়েছে কি-না তার খোঁজ না নিয়ে বড় বড় ইফতার পার্টি করলাম, যা আমরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে অনেকেই করে থাকি তাদের রোজা কবুল হবে কি না একমাত্র আল্লাহই জানেন।
ঈদের আনন্দ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে উপভোগ করা কতো যে আনন্দের তা কম-বেশি সবারই জানা। এই ঈদে স্বার্থপরতা, ভোগের বদলে মিলনের আনন্দই মুখ্য। এই মিলন মানুষে মানুষে, ধনী গরিবে। ঈদ অনেকটাই লাঘব করে দেয়া ঈদের জামাতে মানুষে মানুষে কোলাকুলির মাধ্যমে ভেদাভেদের চিহ্ন। কিন্তু ঈদের দিন আমির-ফকির, ধনী-গরিব এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ ও কোলাকুলি ঠিকই করি কিন্তু বাড়িতে গিয়ে কেউ খান কাচ্চি বিরিয়ানি আর কেউ খান পোড়া মরিচ সহযোগে আলু ভর্তা। কেউ পরেন তালি দেওয়া ছেঁড়া পাঞ্জাবি আবার কেউ পরে কয়েক হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবি। আমাদের উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্তের মা-বোনেরা অনেকেই নাকি প্রতিযোগিতা করে ব্যাংকক সিঙ্গাপুর কোলকাতায় ঈদের বাজার করতে যান। বিত্তবান ঘরের আদরের দুলালীরা নাকি ম্যাচিং করে শাড়ি, লেহেঙ্গা, জুতা আর কসমেটিকের স্তূপে ঘর ভরে তোলেন, তারা নাকি মনে মনে দোয়া করেন, ঈদের দিনটি যদি চব্বিশ ঘণ্টা না হয়ে বাহাত্তর ঘণ্টা লম্বা হতো তবে তাদের ঈদ উপলক্ষে কেনা হরেক রকম বিভিন্ন ফ্যাশনের জামাগুলো অন্তত একবার করে পরতে পারতেন। আমাদের মহান ধর্ম ইসলাম কিন্তু তা সমর্থন করে না। ফ্যাশনের নামে উলঙ্গপনা, বাহারি পোশাকের প্রদর্শন ইমলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। একজনের নির্লজ্জ প্রদর্শনের ব্যয়ে অনেক হতদরিদ্র ঈদের আনন্দের ভাগিদার হতো। আমরা অধিকাংশই যারা সাম্য আর ভেদাভেদ নিয়ে বড় বড় বুলি আউড়াই তারা যদি সবাই হিসাব করে ইসলামের অন্যতম বিধান যাকাত ঠিক মতো আদায় করতাম তাহলে এই ভেদাভেদ অন্তত মুসলমানদের মধ্যে থাকতো না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে যাদের উপর যাকাত ফরজ হয়েছে তারা যদি যথাযথভাবে যাকাত দেন তবে আগামী পনেরো বছর পর যাকাত নেওয়ার মতো গরিব মানুষ পাওয়া যাবে না। তাই আসুন সবাই মিলে ইসলামের অন্যান্য অনুশাসনগুলো যেভাবে পালন করি ঠিক তেমনি সঠিকভাবে যাকাত আদায় করি।
এবার, আমরা ছোটবেলায় কিভাবে ঈদ উদ্যাপন করতাম সে বিষয়ে আলোকপাত করছি। আমাদেরকে সাধারণত ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে নতুন জামা দেওয়া হতো। বহু অনুনয়-বিনয়ের পর নতুন কাপড় ঈদে দেওয়ার অঙ্গীকার করানো হতো বাবা-চাচাদের। ঈদের দশ-পনেরো দিন আগে কোন এক শুভক্ষণে যখন বাবার মেজাজ ফুরফুরে থাকতো তখন আমাদের ভাই-বোনদের সাথে নিয়ে কাপড়ের দোকানে যেতেন। সে সময় রেডিমেড কাপড়ের প্রচলন ছিল না, যদিও কিছু পাওয়া যেতো সেগুলোকে বলা হতো ‘ঠনকা’। কাপড় কেনার সময় আমাদের পছন্দের কোন মূল্য ছিল না। আমাদের বড় চাচা মরহুম মতছিন আলী সাহেবের বড় কাপড়ের গদি ছিল। তিনি তাঁর কর্মচারি ও চামচা পরিবেষ্টিত হয়ে রং যাই হোক আমাদের পছন্দ হোক আর না হোক, কাপড়ের সুতা দেখে টেকসই কিনা যাচাই করে মনাই বাবু টেইলারকে দিয়ে মাপ নেওয়াতেন। তারপর শুরু হতো মনাই বাবুর দোকানে নতুন কাপড় আনার জন্য হাঁটা। মাঝে মাঝে মনাই বাবুর ধমকানিও খেতে হতো। ঈদের সময় বাজারের নামকরা টেইলারবৃন্দ এবং একমাত্র কাপড় ইস্ত্রি ও ধোয়ার জন্য বাবুলালের যে গুরুত্ব বাড়তো তা দেখে মনে হতো তাদের মতো পাওয়ারফুল মানুষ মনে হয় শহরে নাই। সে সময় চুলকাটার ধুম পড়ে যেতো। তখনকার নাপিতরা ছয় আনা দিয়ে যে গোলছাঁট দিতেন, এর ফলে যে অদ্ভুতরূপ মাথায় ধারণ করতো তা কিন্তু ভোলার নয়। যাই হোক বহু হাঁটাহাঁটির পর মনাই বাবুর করুণায় নতুন জামা ডেলিভারি নিয়ে ভাঁজ করে বালিশের নিচে রাখতাম। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভাঙলে নতুন কাপড়ের গন্ধ শুকে প্রাণ জুড়াতাম। ভোর হলে পাড়ার সবাই মিলে নদীর ঘাটে অথবা পুকুরে চিল্লাচিল্লি করে গোসল করার প্রতিযোগিতায় নামতাম। সকালে নতুন জামা পরে গায়ে আতর আর চোখে সুরমা মেখে সেমাই, হান্দেশ, হাছারুটি আর নারকেলের সমসা খেয়ে ঈদের জামাতে যেতাম। এখনকার মতো সেই সময় এতো সেলামির প্রচলন ছিল না। তবুও মুরব্বিদের সেলাম করলে দু’আনা, চার আনা করে পেতাম। সেই পয়সা দিয়ে সবেধন নীলমণি নূরজাহান সিনেমা হলে হুড়াহুড়ি, মারামারি করে টিকেট নিয়ে লাহোরী অথবা বোম্বাইয়া সিনেমা দেখার পর ঈদের আনন্দ পূর্ণ হতো। ঈদের দিন সিনেমা হলের ম্যানেজার সাহেবের ডাঁট দেখে মনে হতো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ূব খা’র পরেই উনার স্থান।
সময় পাল্টেছে, সেই সাথে ঈদ উদ্যাপনের ধারাও পাল্টেছে। সংযমের পরিবর্তে দিনে দিনে ভোগের আর প্রদর্শনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সহানুভূতি আর সহমর্মিতা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এই ঈদে স্বার্থপরতা আর ভোগের বদলে মিলনের আনন্দ হয়ে উঠুক মুখ্য। মিলন হোক সবার মাঝে। ঈদ সবার জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনুক।