সরাসরি প্রসঙ্গের অবতারণা করাই বোধ করি সঙ্গত হবে। প্রসঙ্গটা রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতি সবকটির সঙ্গেই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। অন্তত বিষয়ের বিস্তৃতি সে দিকেই গড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।
একজন লিখেছেনÑ “রাজনীতিহীন রাষ্ট্র কষ্টকল্পিত একটি অবাস্তব বিষয় মাত্র। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকীছু। সুতরাং রাজনীতিকে উপেক্ষা করে দেশের বা আত্মোন্নয়নের চিন্তা অলীক কল্পনা মাত্র।” এই তিনটি বাক্যের মধ্যে আপাতত দৃষ্টিতে কোনও গন্ডগোল কিংবা গোলমান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিন্তু মধ্যম বা দ্বিতীয় বাক্যটি ব্যাকরণগত শতভাগ শুদ্ধতা অঙ্গে ধারণ করলেও বাক্যার্থের দ্বারা প্রকাশিত তাত্ত্বিক ধারণাটি তত্ত্বগত শুদ্ধতার লেশমাত্রও ধারণ করে না। সে জন্য আগেপিছের বাক্যদ্বয়ের অর্থবোধেরও হেরফের ঘটার সম্ভাবনার উদ্রেক হতে পারে এবং তাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে প্রসঙ্গে না গিয়ে দ্বিতীয় বাক্যের প্রসঙ্গে বক্তব্য সীমিত রাখা আপতত সঙ্গত মনে করছি।
দ্বিতীয় বাক্যটি অর্থপ্রকাশে পুরোটাই মিথ্যাচার করছে বা সত্যকে পাল্টে দিয়েছে। যদি বলা হয়Ñ “মানুষ হাত দিয়ে হাঁটে।” তখন বাক্যটি বস্তুগত বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, এটা যে কেউ বুঝতে পারে, খুব একটা বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন পড়ে না। অর্থাৎ বাক্যটি একটি অসম্ভব বিষয় কিংবা বাস্তবতাকে প্রকাশ করছে। “রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু।” এই ছয় শব্দের তথাকথিত সুন্দর ও চমৎকার পান্ডিত্যপূর্ণ বাক্যটিও “মানুষ হাত দিয়ে হাঁটে” বাক্যটির মতোই একটি অবাস্তব প্রপঞ্চকে প্রকাশ করছে। যে কেউ এই বাক্যটির প্রেমে পড়ে যেতেই পারেন, আর তা হলেই প্রতারিত হবেন। এর দ্বারা তিনি “পৃথিবীর চারিদিকে সূর্য ঘুরে” এই বাক্যের মধ্যে লুকানো একটি মিথ্যা পাঠ বা শিক্ষাগ্রহণের ফাঁদে আটকা পড়বেন।
প্রকৃতপ্রস্তাবে রাজনীতি অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনীতি কী কী নিয়ন্ত্রণ করে, না বলে বলা ভাল, অর্থনীতি সবকীছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে। এই তাত্ত্বিক ধারণার পক্ষে এন্তার বাক্য সৃষ্টি করা যায় বা চয়ন করা সম্ভব। যেমনÑ (১) রাজনীতি হল অর্থনীতির গাঢ় অভিব্যক্তি ও সম্পূর্ণতা। (২) প্রধান যে জিনিসটায় রাষ্ট্রের রাজনীতি নির্ধারিত হয় সেটা হল আর্থনীতিক অবস্থা, তাতে প্রভুত্বকারী শ্রেণিটির আর্থনীতিক স্বার্থ। (৩) প্রতিটি শ্রেণির রাজনীতি নির্ধারিত হয় সর্বাগ্রে তার আর্থনীতিক স্বার্থ দিয়ে। (৪) রাজনীতি অর্থনীতির সেবা করে তদুপযোগী ব্যবস্থাটির সমর্থন ও সংরক্ষণ মারফত। (৫) সমাজের উপরি কাঠামো ও তার সমস্ত উপাদান জন্ম নেয় হয় আর্থনীতিক বুনিয়াদ থেকে, নয় প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে। সংশ্লিষ্ট বিষয় সংক্রান্ত এইরূপ বাক্য উদ্ধৃত করার পর অবশ্যই যে কারও স্বীকার করে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয় যে, অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, রাজনীতি অর্থনীতিকে নয়।
অর্থনীতি রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। শ্রেণিস্বার্থ রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রক। রাজনীতি মানে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিসমূহের সম্পর্ক। আর অপরপক্ষের “রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছু।” এই বাক্যটি একটি ফাঁকা বুলি মাত্র। বিদ্যমান সমাজবাস্তবতায় এই বাক্যের কোনও অর্থ হয় না। এটিকে বলা যায়, এক ধরনের অর্থহীনতা কিংবা একেবারেই অন্তঃসারশূন্য বাক্যবাগীশতা কিংবা চমৎকার একটি ভগোলজি। প্রকৃতপ্রস্তাবে রাজনীতি বা সমাজনীতির ক্ষেত্রে এর কোন কার্যকরিতা নেই। অধীত বিদ্যা বা বিজ্ঞান হিসেবে অর্থনীতি বা রাজনীতিতে এমন উদ্ভট উপাত্ত বা তত্ত্ব কিংবা ধারণার কোন অস্তিত্ব নেই।