পাগল হাসান দেড়যুগ আগে সুনামগঞ্জ শহরে একটি প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকুরি করতো। ওই প্রতিষ্ঠানেরই আরেক কর্মীর মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পাতে। অভাব তাকে নিয়ত তাড়া দেয়। দুঃখের সংসারে উপচেপড়া বিরহে পিষ্ট হাসান পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়। পুড়ে পুড়ে সে খাঁটি হয়- মাটির হাসান। প্রকৃতির পাঠশালা থেকে শিক্ষা নেয়। তুমুল বিরহের, অভাবের সংসার তার।
সংসার শুরুর আরো আগ থেকেই পাগলটা গুনগুন গাইতো, সুর করতো, গীত রচনা করতো। সেগুলো তেল চিটচিটে বিছানা বালিশের তলে লুকিয়ে রাখতো। বন্ধুদের আড্ডায় কখনো খোলা গলায় গাইতো দু’চার পদ। বন্ধুজনেরা মরমী সুর ও গায়কীর সমঝদার না হওয়ায় তার সুর ও বাণীগুলো আঁতুড়ঘরেই কাঁদতো। শ্রেণিবৈষম্যের শিকারও হতে হয় অবচেতনে বিভিন্ন স্থানে। এক সময় চাকুরিটাই ছেড়ে দেয়। গীত, সুর, বাণীতেই ঘর বাঁধে। এভাবে পাগল হাসান হয়ে ওঠে। কেউ জানেনা তার দুঃখময় অতীত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মাটির সুরে বোনা তার সহজিয়া গীত– নিয়তিবাদী, বস্তুবাদী, ভাববাদী এবং উভয় সংকটে ভোগা মানুষও লুফে নেয়। সহজ কথায়, গীতল সুরে মানুষ পাগল হয় পাগলের গানে। এ যেন তাদেরই কথা, তাদেরই সুর। যেই সুর অভাব ও টানাপোড়েনে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। চতুর নাগরিকতার ভিড় ঠেলে গোপনে এগিয়েছে অশ্বগতিতে। নাগরিক মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছে ভুল করে হলেও রসেভেজা মাটিতেই থিতু হতে হবে। হাসানরাই এই পথের দিশারী।
গানে তার খ্যাতি আসে। দেশ আন্তর্দেশে ছড়িয়ে পড়ে হাসান। মঞ্চ কাঁপায়। মানুষ মাতে। কিন্তু তার অভাবের সংসারের ছবিটা জীবন শুরুর পর থেকেই শাদাকালো থাকে। দুই সন্তান পৃথিবীতে আসলেও তার সংসারের ছবিটা আর রঙিন হয়না। টানাপোড়েন যেন তার চিরন্তন নিয়তি।
নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষ হাসান। আসর মাতায়। তার নামে দেওয়ানা দর্শক শ্রোতা। পাগল হাসান পাগল হাসান বলে তারা চেচায়। নাগরিক শিল্পীরাও এই সময়ে তার গীতগান কণ্ঠে তুলে নেয়। তারাও খ্যাতি পায়। কাম ও কামাই ভালো হয়। কিন্তু হাসান সেই মরমী মানুষই থেকে যায়।
অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা উত্তোলনের জন্য সাজা সংস্কৃতিকর্মী/সংগঠকদের সঙ্গে চতুর সাংস্কৃতিক আয়োজকরাও তার নির্লোভ ও নির্মোহ ভালো মানুষের মনের সন্ধান পেয়ে যায়। তাকে ধরে আসর মাতানোর মওকা খুজে নামমাত্র পারিশ্রমিকে। আসরের জন্য তার কোন দরদাম নেই। সে কখনো দাম হাঁকিয়ে গাইতে আসেনি। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় চতুরের দল। তারা ২-৫-১০ হাজার টাকা দিয়ে তার সময় কিনে নেয়। পাগলও মনে মনে চতুর মানুষদের চরিত্র ধরতে পেরে নিজেকে উজাড় করে দেয়। কণ্ঠ ছেড়ে মঞ্চকে মাতিয়ে তুলে। মানুষের মন বুঝার পীর হয়ে ওঠে। একের পর এক গান গেয়ে আসর মাতিয়ে বিদায় নেয়। মঞ্চ তার নাম গাইতে থাকে। হাততালি দিতে থাকে। কিন্তু তার ভিতরের দহন, অভাবের কাহন সবাই ভুলে যায়। কণ্ঠ ব্যবহারকারীরা জেনেও নিজেদের পুষ্ট করে।
পাগল হয়তো চতুর মানুষদের সেই ধর্মটা বুঝতো। তাদের দ্বিচারি স্বত্ত্বার খবর সে জানতো। তাই সঙ্গীত পরিভ্রমণে নিজেকে প্রোজ্জ্বলভাবে তৈরি করে। অর্থ নয়, বিত্ত নয় সঙ্গীতই তাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। তাকে লোকমানস সঙ্গীত স¤্রাটের আসনে বসায়। সেই আসনে নিজেকে তুমুলভাবে উপস্থাপন করেই চলে গেল সে। তার অভাবের সংসারে আর ফিরলোনা সচ্ছলতা। স্ত্রী, দুই ছেলে, মা ও বোনরাও হাবুডুবু খাবে। খাবি খাবে অভাবে। আর আমরা মৃত্যুবার্ষিকী আসলে আবারও তাকে নিয়ে মাতবো। এই ছিল, সেই ছিল বলে মঞ্চে মুখ দেখাবো, হয়তো দুএক ফোটা মেকি অশ্রুও ঝরাবো। কিন্তু তার অন্তরে অন্তরে নিজেদের মিশাইতে পারবোনা। তার অভাবের বেদনাকে নিজের করতে পারবনা।
গানের মতোই ‘মইরা গিয়ে কদর বাইড়া যায়’ হয়ে গেল হাসান। কেউ জানলোনা তার ‘কত জ্বালা লইয়া পাগল মন মজাইলা সুরে/মাথা ঝুলে হেলে দুলে পুড়ছে হৃদয় পুরে’। পুড়ে পুড়ে খাটি হওয়া পাগল হাসানের জন্য আমার অশ্রুগাথা।