1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৮:৪৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

২৩ নাবিকের ভয়ঙ্কর ৩৩ দিন

  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
১২ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টা। সোমালিয়া উপকূল থেকে বেশ দূর দিয়ে আরব আমিরাতের লক্ষ্যে ছুটছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজের দীর্ঘযাত্রায় ক্লান্তি ভর করেছিল ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের চোখে। এর মধ্যেই কয়েকবার জাহাজের গতি ও দিক পরিবর্তনের বিষয়টি নজরে আসে তার। দ্রুততার সঙ্গে তিনি যখন পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন, তখনি জাহাজের বিপদ সংকেত সাইরেন বেজে ওঠে।
বিপদ আঁচ করতে পেরে যখন নাবিকরা জাহাজের সিটাডেলে (সুরক্ষিত কক্ষ) আশ্রয় নেওয়া চেষ্টা করছিলেন, তখনি মাইকে নির্দেশ আসে সবাইকে ব্রিজে যাওয়ার। ভয়ার্ত নাবিকরা জাহাজের ব্রিজে গিয়ে দেখেন এরই মধ্যেই জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরীকে গানপয়েন্টে নিয়েছে জলদস্যুরা। নিজেদের জিম্মিদশার শুরুর দিকের ঘটনা এভাবেই গণমাধ্যমের কাছে বর্ণনা করেছিলেন এমভি আবদুল্লাহর ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বৃহ¯পতিবার (১৮ এপ্রিল) রাতে তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান বলেন, দুইজন ছাড়া বাকি সবাইকে সিটাডেলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু দস্যুরা অতি দ্রুততার সঙ্গে জাহাজে উঠে সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে ফেলে। তখন আমরা সিটাডেলে না গিয়ে ব্রিজে চলে যাই। জলদস্যুরা তখন ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। ঠিক ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, আর বেঁচে ফেরা হবে না, দেখা হবে না মায়ের মুখ।
নাবিকের জিম্মিদশার ভয়ঙ্কর প্রথম কয়েক ঘণ্টার বিবরণ উঠে এসেছে এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খানের বর্ণনায়ও।
আতিক উল্লাহ খান বলেন, গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট। এসময় একটা হাই ¯িপডবোট (দ্রুতগতির ¯িপডবোট) আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম দিই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা (জলদস্যুরা) চলে এলো।
তিনি বলেন, তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেললো। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই এলাম। এসময় কিছুটা গোলাগুলি হয়। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারো গায়ে হাত দেয়নি।
জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কেবিনে অফিসের কাজ সেরে ব্রিজে গিয়ে বসি। তখন জাহাজের তৃতীয় কর্মকর্তা জানান, জাহাজের ডান পাশে অনেক দূরে একটি ফিশিং বোট দেখা যাচ্ছে। ফিশিং বোটটি দেখেই ব্যবধান বাড়াতে এমভি আবদুল্লাহকে বাঁয়ে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বলি। এর মধ্যেই ওই ফিশিং বোট থেকে একটি ¯িপডবোট সাগরে ভাসানো হয়। তখনই নিশ্চিত হই জলদস্যুরা আসছে।
তিনি আরও বলেন, ¯িপডবোটটি কাছাকাছি চলে এলে ঢেউ সৃষ্টি করে পানি ছিঁটিয়ে দস্যুদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ডানে-বাঁয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে গতি কমানোর চেষ্টা শুরু করা হয় ¯িপডবোটটির। কিন্তু ততক্ষণে জলদস্যুদের কয়েকজন জাহাজে উঠে যায়। প্রথমেই তারা জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে মাস্টারকে (আমাকে) খুঁজতে থাকে। প্রাণহানির শঙ্কায় আমি হাত তুলে জলস্যুদের ধরা দিই। এসময় বাকি নাবিকদের সিটাডেলে যাওয়া বন্ধ করে ব্রিজে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্রিজে আসার পর ২৩ নাবিকই হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন। অপর একটি ¯িপডবোটে করে আরও পাঁচজন জলদস্যু জাহাজে আসে। এসেই তারা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তখন সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জলদস্যুরা ২৩ নাবিককে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে বন্দুক তাক করে থাকে। জিম্মির প্রথমদিন জলদস্যুরা ছিল ১২ জন। জলদস্যুরা প্রথমে ভেবেছিল জাহাজটির সবাই ভারতীয়। তখন জলদস্যুদের বোঝানো হয় আমরা মুসলিম এবং বাংলাদেশি।
ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান বলেন, প্রথম দিকে খুবই ভয় পেয়েছিলাম। জিম্মি হওয়ার আগমুহূর্তে বাড়িতে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। জাহাজ যখন সোমালিয়া তীরের দিকে নিয়ে যায়। তখন এমন একটা সময় গেছে- এই মনে হয় গুলি মেরে দিলো, এই মনে হয় মেরে ফেলবে।
জাহাজের সিনিয়ররা শুরুতেই জলদস্যুদের বোঝাতে সক্ষম হয় জানিয়ে আইয়ুব খান বলেন, সত্যি বলতে ওরা আমাদের কারো গায়ে হাত দেয়নি। আমাদের ক্যাপ্টেন স্যারসহ সিনিয়ররা ওদের প্রথমেই কথার মাধ্যমে একটা কমফোর্টেবল জোনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। যাতে আমাদের গায়ে হাত না দেয়। আমাদের ফ্যাসিলিটিগুলো বন্ধ হয়ে না যায়।
জিম্মিদশার শুরুতে ‘আহমেদ’ নামে এক ব্যক্তি জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপরই জাহাজটি কীভাবে কোথায় নিতে হবে, তার পথ নির্দেশনা দিয়ে দেয় জলদস্যু নেতা। তারপরই জাহাজ সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে ইফতার তৈরির জন্য জাহাজের চিফ কুককে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন ক্যাপ্টেন। সেদিন নাবিকরা ছোলা দিয়ে ইফতার করেন।
জিম্মিদশার দ্বিতীয় দিন ইফতারের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অপারেশন আটলান্টার একটি যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর পিছু নেয়। যুদ্ধজাহাজ থেকে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ভিএইচএফে জলদস্যুদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ অবস্থায় জলদস্যুরা নাবিকদের আবারও গানপয়েন্টে নিয়ে হত্যার হুমকি দেয়।
ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ বলেন, প্রাণহানির আশঙ্কায় তিনি ভিএইচএফে যুদ্ধ জাহাজটিকে নিজেদের অস্ত্রের মুখে থাকার কথা জানিয়ে দূরে চলে যেতে অনুরোধ করেন। প্রায় আধাঘণ্টা পর যুদ্ধজাহাজটি দূরে চলে যায়। দুদিন পর বাংলাদেশি জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছায়। এরই মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি চলে আসে। পরে সেটিকেও একই কারণে চলে যেতে বলেন ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।
যুদ্ধজাহাজ পিছু নেওয়ায় জলদস্যুরা উপকূল থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে জাহাজে। রকেট লঞ্চার, মেশিনগান, এম-সিক্সটিনসহ নানা রকমের অস্ত্র। অস্ত্রের আয়োজন দেখে ভয় পেয়ে যান নাবিকরা। অবশ্য জাহাজগুলো সরে যাওয়ায় বিপদ কাটে। ১৬ মার্চ থেকে নাবিকরা জাহাজের ডেক এবং ইঞ্জিন রুমের রুটিন কাজ শুরু করেন।
ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান বলেন, আস্তে আস্তে যখন কয়েকদিন থাকলাম, ভয় একটু কমলো। বুঝলাম কো¤পানির কাছ থেকে মুক্তিপণ পেলে আমাদের ছেড়ে দেবে। এমনিতেই রোজার মাস, তার মধ্যে কাজে (রুটিন মেনটেইনেনস) সময় দিলে একটু খুশি লাগতো। শুরুর দিকে ব্রিজ কক্ষে গাদাগাদি করে থাকলেও পরে আমাদের কেবিনে যাওয়ার পারমিশন দেওয়া হয়। শেষের দিকে যখন আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, কো¤পানির সঙ্গে নেগোসিয়েশন হয়ে গেছে। তখন মনের মধ্যে আনন্দ কাজ করতো। কখন টাকা আসবে, কখন আমরা ছাড়া পাবো… এ আলোচনা-ই হতো আমাদের মধ্যে।- যোগ করেন আইয়ুব খান।
চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সময় এমভি আবদুল্লাহ’য় তিন মাসের খাবার মজুত করা হয়েছিল। তবে জিম্মিদশা দীর্ঘ হয় সেই আশঙ্কায় নাবিকরা পানি ও খাবার রেশনিং করেন।
ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ বলেন, জলদস্যুরা জাহাজে দুম্বা নিয়ে আসতো। গরম পানিতে সেদ্ধ করে লবণ ও কিছু মসলা মিশিয়ে তারা তা খেতো। কিন্তু বাংলাদেশি নাবিকদের জন্য তা খাওয়ার অযোগ্য ছিল। একপর্যায়ে দস্যুরা নিজেদের রান্না করার জন্য লোক নিয়ে আসে জাহাজে। নাবিকরা ইফতারের সময় লেবুসহ নানা ধরনের শরবত পান করতাম। সেহরিতে ভাতের পাশাপাশি দুধ থাকতো। পানি সাশ্রয়ে সপ্তাহে দু’দিন গোসল করতেন নাবিকরা। বাথরুমে ব্যবহার হতো সাগরের পানি।
মুক্তির সব প্রক্রিয়া যখন প্রায় শেষ তখন নাবিকদের ঈদের নামাজ পড়ার ছবি ভাইরাল হলে চাপে পড়েন নাবিকরা। ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান বলেন, কিন্তু ঈদের ছবি ভাইরাল হওয়ার কারণে আমরা আবারও প্রেসারে পরে যাই। জলদস্যুরা বলছিল এটা তাদের জন্য থ্রেট। পরে তাদের বিষয়টি বোঝানো হয়। ওই ঘটনার তিনদিনের মাথায় মুক্তিপণের টাকা পাঠায় জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপ।
সেই মুহূর্তের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাবিকরা বলেন, ডলারভর্তি ব্যাগ পানিতে ফেলার আগে নাবিকদের জাহাজের ডেকে নিয়ে এসে এক লাইনে দাঁড় করায় দস্যুরা। পেছন থেকে নাবিকদের দিকে অস্ত্র তাক করেছিল। জাহাজের পাশে ¯িপডবোটে অপেক্ষায় ছিল দস্যুদের আরেক দল। ছোট একটা উড়োজাহাজ থেকে জাহাজের পাশে সাগরে ডলারভর্তি ব্যাগ ফেলে দেয়। মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধের সময় জিম্মি জাহাজটির অদূরে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ।
১২ এপ্রিল শনিবার বিকেলে মুক্তিপণের অর্থ পায় দস্যুরা। পরে ওইদিন গভীর রাতে দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে যায়। যে মুহূর্তটা ছিল নাবিকদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের। তখনই নোঙর তোলা হয় এমভি আবদুল্লাহর। নতুন জীবন নিয়ে ২৩ নাবিক যাত্রা করেন আরব আমিরাতের পথে।

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com