এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়ে, তুমি কাঁদো আমি কাঁদি… কাঁদছে সারা বিশ্ব। কেবল নিজের জন্য নয়। বৈশ্বিক দুর্যোগে বিশ্বজনীন ভাবনা, দুশ্চিন্তা। বিশ্বময় আতঙ্কের ভার, দমবন্ধ করা উদ্বেগ। মৃত্যুর সংখ্যা গণনা। দিনের সঙ্গে গাণিতিক নিকেশ।
ঘরে আবদ্ধ থাকলেও আমাদের জীবনটা এখন আর এই বাড়িটিমাত্র নয়। এই গ্রাম বা এই শহর মাত্র নয়। এই নদী, ধানক্ষেত, দোয়েল, শাপলা, ঘাস, বন-বনানীর শ্যামল দেশটি শুধু নয়। জীবন এখন ছড়ায়ে আছে বিস্তৃত বিশ্বময়। আমার সন্তান, স্বজন, আপনজন বিশ্বের একোণে, ওকোণে। দেশের সঙ্গে নাড়ির টান ঠিকই কিন্তু ভুবনময় আত্মার টানও যে জড়িয়ে আছে। ন্যুয়র্কের ঘটনা যেভাবে শংকিত করে, একইভাবে লন্ডনের জন্য উৎকণ্ঠা, দিল্লী, কোলকাতা, মন্ট্রিল, মাদ্রিদের জন্য উদ্বেগ। এক অনিশ্চয়তার পথে হাঁটছে বিশ্ব। গোটা মানবজাতির একই আহাজারি। মৃত্যু থামুক। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার মাঝেও মৃত্যুর কাছে মানুষের কী অসহায় আত্মসমর্পণ।
মনুষ্য জীবনের কী করুণ পরিণতি। সাদা-কালো, ধর্ম-গোত্র, আকার-আকৃতি, ক্ষমতাধর-দুর্বল, লিঙ্গ, পেশা নির্বিশেষে অদৃশ্য এক রহস্যময় প্রবল শত্রুর আক্রমণের শিকার মানবকুল। রাজপ্রাসাদ থেকে রাজপথ, লোকালয়, জনপদ, নগর, বন্দরে ঘুরঘুর করছে মহামারি। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলিতেও অক্ষমতার প্রকট প্রকাশ। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই। হাসপাতাল পূর্ণ। মাঠ, স্টেডিয়ামগুলি এখন কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ডেরা। ক্ষমতার বড়াই, সম্পদের অহমিকা, শক্তির হুংকার, অস্ত্রের ঝনঝনানি চাপা পড়ে গেছে মুমূর্ষুর করুণ আর্তনাদে। জীবন বাঁচাও। এতো সম্পদ কার ভোগে লাগবে, মজুদ গোলা বারুদ কার প্রাণ নেবে, ক্ষমতার দম্ভ কোথায় প্রদর্শন হবে মানুষই যদি না থাকে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ঘাড়ের কাছে উদ্ধত বিষাক্ত ফণা নিঃশ্বাস ফেলছে। যুতসই ছোবল এখনও বসেনি। কিন্তু কতক্ষণ। তাপমাত্রা তত্ত্ব, ইমুইনিটি তত্ত্ব, টিকা তত্ত্ব বাদ দিলেও হতভাগারা সময় পেয়েছিল, চোখের সামনে উদাহরণ ছিল। করুণ পরিণতির চিত্র ছিল। সুযোগ ছিল। যথাযথ কাজে লাগানো যায়নি অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, লোভের কারণে। যতই মধ্যম আয়ের পর্যায়ে বলে গলা ফাটাই না কেনো, আমরা দরিদ্র- আচারে, আচরণে, নীতি-নৈতিকতায়। সাধারণ শ্রেণি আর্থিকভাবেও।
লক ডাউনের নামে আমাদের বজ্র আঁটুনী ফস্কা গেরো। সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতায় একবার মানুষকে ঘরে ঠেলছে আরেকবার বের করে এনে তুলে দিচ্ছে মৃত্যু মিছিলে। মানবতার এমন পতন। কে বলবে- আগে শ্রমিক বাঁচুক। তারপর মিল, উৎপাদন, মুনাফা। কাকে দিয়ে মিল চলবে শ্রমিকই যদি না বাঁচে। এখন কেউ একা মরে না। এক মৃত্যু অনেক মৃত্যুর বিস্তার ঘটায়। দলে দলে মরে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়। মানুষ বাঁচতে চায় ঠিকই। বাঁচার জন্য লড়াই করে। কিন্তু সচেতন হতে পারে না, সতর্ক থাকতে পারে না। মনে হয় এমন জীবন উদাসী মানুষ আর কোথাও নাই। তবু মানুষ বাঁচুক। আগামীর সুন্দর পৃথিবী গড়ুক। এক পরিশুদ্ধ পৃথিবী আসুক।
আজকের দিনে যারা লড়ছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্তব্য পালন করছেন, দিনরাত দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, সেবা দিচ্ছেন, তাঁরাই সময়ের বীর। স্বাস্থ্যকর্মী যাঁরা সম্মুখ যুদ্ধে করোনার চোখে চোখ রেখে লড়ছেন, আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের জন্য প্রার্থনা ও সংহতি। এ যুদ্ধে যদি মানুষ জয়ী হয়, সভ্যতা যদি রক্ষা পায় তবে ইতিহাস সাক্ষী, বিজয়ের গৌরব মুকুট তোমাদেরই।