ইদানীং দেখা যাচ্ছে পাড়া-পড়শী ও শহরের কিছু মানুষ আমার কাছে তাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ বা আলোচনা করতে আসেন। আমি অনেক সময় অপরাগতা প্রকাশ করলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, আপনি বিভিন্ন বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় লিখেন বহু সমস্যারও সমাধান দেখি আপনার লেখায়, আর আমার এ সামান্য সমস্যা সমাধানে একটু উপদেশ আমার সুবিধা হয়।
ষোলঘরের আব্দুল মতিন সাহেব দুই জন কন্যা সন্তানের পিতা। অনেকেই বলে থাকেন কন্যা সন্তানের পিতারা নাকি ভাগ্যবান হয়ে থাকেন। শুধু আব্দুল মতিন সাহেবের মতো দুই কন্যা সন্তানের অধিক পাঁচ-ছয় কন্যা সন্তানের বাবা-মাও এই শহরে আছেন। প্রতিটি কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা চান তার কন্যা সর্বগুণে গুণান্বিত হয়ে ভালো পাস-টাস দিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে স্বামীর ঘরকে আলোকিত করে তুলবে। মেয়ে সন্তানের পিতা-মাতারা কামনা করেন বিয়ের পর তার মেয়ে যেন শ্বশুর বাড়ি গিয়ে আদরে, সোহাগে থাকে। অনেক পিতা-মাতার মেয়েদের বিয়ে দেবার বেলায় পছন্দের তালিকায় বর বিদেশে ভালো চাকরিরত মোটা অঙ্কের বেতনধারী শিক্ষিত ও মার্জিত জামাই, তারপর রয়েছে দেশীয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা বি.সি.এস. ক্যাডার জামাই। শিক্ষিত ও ভালোঘরের উপযোগী করে গড়ে তুলার জন্য মেয়ের মেধা থাকুক আর না থাকুক তাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার আশায় লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেন অনেক কন্যা সন্তানের পিতারা প্রাইভেট টিউটর ও কোচিংয়ের পেছনে। একটি মেয়ে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত টিউটরের বকবকানি, স্কুল কলেজে সারাদিন ক্লাস করে দম ফেলার ফুসরত থাকে না। এভাবে চলতে গিয়ে অনেকসময় হয়ে যায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সামাজিক জীবনের অন্যান্য আনুষাঙ্গিক শিক্ষা হতে বিচ্ছিন্ন। আমি অনেককেই দেখেছি পড়ার চাপে বিপর্যস্ত। অভিভাবকদের একটাই লক্ষ্য মেয়ে যেন গোল্ডেন জি.পি.এ ফাইভ পেয়ে পাস করে ভালো ভালো বিষয়ে লেখাপড়া। এটি করলেই বুঝি ভালো জামাই পাওয়া যাবে। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে সুখের অনাবিল সাগরে ভাসবে।
আমরা আমাদের কন্যা সন্তানকে সাংসারিক কাজকর্ম শিখাই না, যেমন- ঘর ঝাড়–, রান্না থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার পর্যন্ত শিখতে হবে। বিদেশ বাদ দিলাম দেশেই যদি কোনো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বি.সি.এস ক্যাডারের সাথে আপনার কন্যা রতœটির যদি বিয়ে হয়, আপনার জামাই যদি সৎ এবং নিষ্ঠাবান হয় ঘুষ না খায় তাহলে সে যে বেতন পাবে তা দিয়ে পেট বাঁচানোই দায়। কারণ চাকরির প্রাথমিক অবস্থায় মেয়ের জন্য দাস-দাসী রাখা দূরের কথা সুদূর পরাহত।
তার উপর যদি আমার মতো ছেলের রোজগার খাওয়া শ্বশুর হয় তাহলে কিন্তু বারোটা বাজবে। এটা নিয়ে বর্তমানে দেশে-বিদেশে প্রচুর সমস্যা হচ্ছে, ঘর ভাঙ্গা-ভাঙ্গিও হচ্ছে। তাই আমি মনে করি মেয়েদেরকে শুধু পুস্তক সর্বস্ব বিদ্যায় আবদ্ধ না রেখে সাংসারিক কাজকর্মও শেখানো উচিত।
অনেক মা গর্ব করে বলেন, আমার মেয়ে রুনা লায়লার মত গান গাইতে পারে কিন্তু ডিম ভাজতেই জানেনা।
এগুলো গর্বের কথা নয়। দেশে এবং বিদেশে কত মেয়ের নাকের পানি, চোখের পানি একাকার হতে দেখেছি। তাই সবিনয়ে অনুরোধ করছি মেয়ের বাবা-মাকেÑ পুঁথিগতবিদ্যা যতো খুশি মেয়েকে দেন পাশাপাশি সাংসারিক কাজে, আত্মীয়-স্বজনদের আপ্যায়নে, সবার সাথে খাপ-খাইয়ে নেওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলুন। আপনার যত বড়ই প্রাসাদ থাকুক, ব্যাংক ভরা যত টাকাই থাকুক সবই বৃথা, যদি শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে কষ্ট পেয়ে কন্যার এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে।
আজকে আমরা যারা পিতা-মাতা আছি তাদের ভুলে অনেক ছেলে-মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। চেনা নেই জানা নেই, কোথায় লেখাপড়া করেছে, কোন পরিবেশে বড় হয়েছে, চরিত্রে পচন ধরেছে কিনা তার কোনো খোঁজখবর না নিয়েই লাল পাসপোর্টধারী ছেলে হলেই নিজের মেয়েকে সেই ছেলের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামি। মাতাল, মদ্যপ, জুয়াড়ি ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার ফলে অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট হতে চলেছে। অনেক সময় আবার ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হওয়ার কারণে দু’জনে দু’জনার ত্রুটিগুলো মেনে নিতে না পারার ফলে সৃষ্টি হয় প্রবল ইগো প্রবলেম। দু’জনার ইগো যদি প্রবল থাকে তবে সৃষ্ট হয়না অ্যাডজাস্ট করার মন-মানসিকতা। আর স্বামীর প্রবরের প্রভুত্ব ফলানোর প্রবণতা একটু বেশি হলে অধিকাংশ মেয়েই হয়ে উঠে এগ্রেসিভ। পরিণামে শুরু হয় অশান্তি নয়তো ছাড়াছাড়ি। একটি মেয়ের অনেক চাওয়া-পাওয়ার আছে। তাই বলছি শুধু গোল্ডেন জি.পি.এ ফাইভ পাওয়ার চাপ নয় তার মানসিক বিকাশ, সর্বক্ষেত্রে মানিয়ে চলার শিক্ষার পাশাপাশি আপনার কন্যা রতœটির অমতে বিয়ে ঠিক করবেন না। নইলে বলা যায় না সারা জীবন পস্তাতে হতে পারে।
আমার নিজেরও কন্যা সন্তান রয়েছে। বোন-ভাগ্নি, নাতি-নাতনীর অভাব নেই। সংসারে মুরুব্বি হওয়ায় বিয়ে-সাদীর ব্যাপারে জড়িত থাকতে হয়। সমস্যা হলে সমাধান করতে হয়। শহরেরও কিছু কিছু কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সমস্যা শুনে সমাধানের পথে সাহায্য করতে হয়, যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে অন্যদের সমস্যা নিজের সমস্যা মনে করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
ঘরে ঘরে শান্তি বিরাজ করুক। আমাদের কন্যা সন্তানেরা, সুখে-শান্তিতে দা¤পত্য জীবন কাটাক এই কামনা করি।