1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৭:৪১ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

উন্নয়ন, আলতাদিঘী ও অন্যান্য বিতর্ক : আমীন আল রশীদ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ প্রকল্পের নামে হাজারো গাছ কেটে ওই এলাকাকে যে মরুভূমি বানানো হয়েছে, সেই ছবি এখন ভাসছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারিত হয়েছে গণমাধ্যমে। পরিহাস হলো, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায়।
স্মরণ করা যেতে পারে, এই ফান্ডের আওতায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্পের অভাবনীয় দুর্নীতি একসময় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। যে প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ঘরে ছিল শুধু দেয়াল এবং ছাদ। দরজা জানালা তো ছিলই না, এমনকি একটি অবকাঠামোকে যেসব কারণে ঘর বলা চলে, সেখানে তাও ছিল না। জলবায়ু তহবিলের অর্থ কীভাবে নয়ছয় হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর প্রকল্প নেওয়ার বদলে ‘উন্নয়ন’ শব্দটিকে কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় – তা এইসব কর্মকা-ে স্পষ্ট।
লজ্জার বিষয় হলো, উন্নয়নের এই বিকৃতিগুলো ঘটছে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন নেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারাই। অথচ এইসব ঘটনায় কাউকে বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে বা কোনও ধরনের জবাবদিহির মধ্যে আসতে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। তার মানে উন্নয়নের এইসব বিকৃতির পেছনে রাষ্ট্রের সায় আছে অথবা রাষ্ট্র বা সরকার এইসব লোকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, আলতাদিঘী উদ্যানের দিঘী খনন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, গাছ রোপণসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ১৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গাছ রোপণের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাটা হয়েছে হাজারো গাছ। ব্যাপারটা এমন যে, আগে গাছ কেটে বন জঙ্গল সাফ করো। তারপর সেই শূন্য ভিটায় গাছ লাগাও। নাম ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প’। অথচ চারপাশ ফাঁকা করে দিয়ে দিঘী ও বনের প্রতিবেশ নষ্ট করা হলো। ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা করা হলো। অথচ গাছ কেটে সেখানে দেয়াল তুলে দেওয়া হলো। বনের ভেতরে বানানো হলো দালান। এরকম উদ্ভট উন্নয়নচিন্তা যাদের মাথা থেকে আসে, তাদেরকে ‘মেধাবী’ না বলে উপায় নেই!
উদ্যানের উন্নয়নের জন্য গঠিত কমিটির একজন সদস্য চ্যানেল টোয়েন্টিফোরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আলোচনা সভায় উদ্যানের গাছ কাটার কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে আলতাদিঘীতে গিয়ে তারা দেখতে পান অনেক বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বন কর্মকর্তা এর সপক্ষে অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে বলেছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গাছগুলো কাটা হয়েছে। কী অসাধারণ কথা! একটা গাছ কত বছর বয়স হলে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়? গাছ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেগুলো যে কেটে ফেলতে হয়- এমন আবিষ্কারের জন্য এই ভদ্রলোককে তো পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল দেওয়া উচিত! একই সুর নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কণ্ঠেও। তিনিও বলছেন, প্রয়োজনের তাগিদেই গাছ কাটা হয়েছে। এখানে নতুন নতুন গাছ রোপণ করা হবে। এই না হলে বন কর্মকর্তা! এই না হলে জেলা প্রশাসক!
প্রসঙ্গত, ২৬৪ একর বিশাল বনভূমির মাঝে ৪৩ একর আয়তনের আলতাদিঘী। যার দৈর্ঘ্য প্রায় এক দশমিক দুই কিলোমিটার। দিঘীটি ভারত সীমান্ত লাগোয়া। ফলে এখানে যখন খননকাজ শুরু হয়, তখন নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে কয়েকবার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। দু দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলাপ-আলোচনার পরে পুনরায় খনন শুরু হয়।
অপু নজরুল নামে একজন পর্যটক নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন: ‘আলতাদীঘি এখন ন্যাশনাল পার্ক ঘোষিত হয়েছে তাই উন্নয়নকাজ চলমান। বনের চারদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ওয়াল করা হচ্ছে, সাথে পিকনিক স্পট, অদ্ভুত দর্শন ছাতা আর অযাচিত ওয়াচ টাওয়ার। আর এই সবই করা হচ্ছে গাছ কেটে! সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার, পুরো দিঘীর পাড় বাঁধাই করে ফেলা হয়েছে। পদ্ম দূরে থাক- দীঘিতে পানিই নেই।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদও সরব হয়েছেন আলতাদিঘীর এই উদ্ভট উন্নয়ন দর্শনের বিরুদ্ধে। নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি লিখেছেন: ‘খবরে দেখলাম, এখানে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র করা হবে। অন্য একটি খবরে দেখলাম, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় সমৃদ্ধ এই আলতাদিঘী জাতীয় উদ্যানে এক মাসের ৯ বার আগুন লেগেছে। কেন আমরা এমন হয়ে গেলাম? প্রাকৃতিক পরিবেশের বদলে কসমিক বিনোদন কেন্দ্র বানানো কেন আমাদের কাছে বেশি আদরনীয় হয়ে গেলো? কোন লেভেলের পারভার্সন।’
মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কত গাছ কাটা পড়েছে?
সম্প্রতি গরমের তীব্রতা বেড়ে গেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই এর জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের নামে লাখ লাখ গাছ কেটে ফেলাকে দায়ী করেন। এ সময় কেউ কেউ লিখেছেন, চট্টগ্রামের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল। প্রশ্ন হলো, এইসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কী পরিমাণ গাছ কাটতে হয়েছে? বন বিভাগের কাছে কি এর সঠিক পরিসংখ্যান আছে?
বন বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় যেকোনও উন্নয়ন কাজ করতে গেলে, বিশেষ করে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে সেখানে কী পরিমাণ গাছ কাটা পড়বে, এসব গাছের মূল্য কত, কী ধরনের গাছ, কোন গাছের বয়স কত, জীববৈচিত্র্যের কী কী ক্ষতি হবে ইত্যাদি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়।
পরিবেশ গবেষক মোস্তফা ইউসুফ – যিনি একসময় সাংবাদিকতা করতেন এবং চট্টগ্রামের পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে যার অনেকগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রয়েছে, তিনি জানান, পত্রিকার জন্য রিপোর্ট করতে গিয়ে তিনি বন বিভাগের প্রতিবেদন থেকেই জেনেছেন যে, মীরসরাই ইকোনমিক জোনে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫২ লাখ গাছ কাটা হয়েছে। এই বন ছিল ৭ হাজার হরিণের আবাসস্থল। অতএব বন উজাড়ের ফলে সেই ৭ হাজার হরিণ কোথায় গেলো, সেটিও বিরাট প্রশ্ন। তাছাড়া এর মধ্যে ম্যানগ্রোভ বনও ছিল – যা সৃষ্টি করা হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। বাংলাদেশের মতো সমুদ্র উপকূলীয় দেশের জন্য ম্যানগ্রোভ বন প্রকৃতির বিরাট আশীর্বাদ। অথচ সেই ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে। ইকোনমিক জোনের নামে। একটি দেশে, জনপদে, তার প্রকৃতিতে একটি ম্যানগ্রোভ বনের মূল্য কত আর সেই ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে যে প্রকল্প বানানো হয়, তার অর্থনৈতিক মূল্য কত – সেই হিসাব করারও সময় এসেছে।
প্রশ্ন হলো, কোনও সুস্থ মানুষের মাথায় এই ধরনের চিন্তা আসতে পারে? যারা এইসব পরিকল্পনা করেন, তারা দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থী। দারুণ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সরকারি চাকরি পেয়েছেন। নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে প্রজাতন্ত্রের সিনিয়র কর্মকর্তা হয়েছেন। তারা কী করে দেশের নদী-খাল-বন-পাহাড় ও প্রাণ-প্রকৃতির ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেন? তাদের বিবেক একটুও বাধা দেয় না? তারা কি সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে এই ধরনের প্রকল্পের নকশা ও বাস্তবায়ন করেন? নাকি রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন? যদি তাই হয় তাহলে আজ পর্যন্ত কোনও আমলা কি এই ধরনের রাজনৈতিক চাপের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ করেছেন বা প্রতিবাদ করতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন – এরকম ঘটনা ঘটেছে? নাকি রাজনৈতিক চাপের দোহাই দিয়ে তারা পার পেয়ে যান এবং বিনিময়ে নিজের না হলেও স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যাংক ব্যালান্স ভারী করেন?
যাদের মাথা থেকে এইসব আইডিয়া আসে, তাদের কাছে দেশ, জনগণ, পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির ন্যূনতম কোনও গুরুত্ব নেই? একজন মানুষের মধ্যে ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকলে তিনি কি এই ধরনের প্রাণ-প্রকৃতিবিরোধী প্রকল্পের নকশা ও বাস্তবায়ন করতে পারেন? নাকি টাকার লোভে তাদের মন থেকে দেশপ্রেম তো বটেই, মনুষ্যত্ববোধটুকুও হারিয়ে গেছে? প্রকল্প আর টাকার কাছে মানুষ এতটাই আত্মসমর্পণ করে দেবে যে, ৫০ বছর পরে এই দেশের মানুষ কী করে বাঁচবে, সেই ভাবনাটুকও তাদের মধ্যে কাজ করবে না?
লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com