সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
অদূরে অবস্থানকারী পরাশক্তি বছরের পর বছর তাকে হত্যা, ক্ষমতাচ্যুত ও একঘরে করতে চেয়েছে। বারবারই ব্যর্থ হয়েছে তারা। আইজেনহাওয়ার থেকে বিল ক্লিনটন। একের পর এক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বসেছেন মার্কিন মসনদে। একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাকে হত্যা, কিংবা উৎখাতের চেষ্টা করে গিয়েছেন। বার্লিন দেয়ালের পতন হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। কিন্তু তিনি মাথা নত করেননি। এভাবে প্রায় ছয় দশক গত হয়েছে। অবশেষে ফিদেল কাস্ত্রো জানালেন, তিনি অজর ও অক্ষয় নন! শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানতেই হলো তাকে। ৯০ বছর বয়সে মারা গেছেন ফিদেল আলেহান্দ্রো ক্যাস্ত্রো ক্রুজ। শনিবার কিউবার রাজধানী হাভানায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজীবন মৃত্যুর সঙ্গেই ছিল তার বসবাস। জীবদ্দশায় কয়েকশবার তার প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে। এসব হামলা চালিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)। বরাবরই তিনি ছিলেন মার্কিন ওই গোয়েন্দা সংস্থার হিটলিস্টে।
গুলি করে গুপ্তহত্যা থেকে বিষ প্রয়োগ, বিষাক্ত কলম, এমনকি ভয়ঙ্কর ব্যাকটেরিয়া পাউডার দিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ক্যাস্ত্রোর মার্কিন আশ্রিত বোন হুয়ানিতা তার লেখা একটি বইয়ে স্বীকার করেছেন, তিনি ফিদেলকে উৎখাতে সিআইএর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন যদিও তাতে সফল হননি। মৃত্যুঞ্জয়ী এক বিপ্লবীর মহাপ্রয়াণ বিশ্বে তিনি পুঁজিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠস্বর, সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী এক প্রতীকের নাম। বর্তমান শতাব্দীর ‘সর্বশেষ বিপ্লবী’। পশ্চিমা চোখ রাঙানির উপেক্ষা করেই তিনি কিউবাকে নিয়ে গেছেন উন্নতির শিখরে।
১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার পূর্বাঞ্চলে বিরান জেলায় ¯েপনীয় বংশোদ্ভূত এক অসচ্ছল অভিবাসী পরিবারে জন্ম ফিদেল ক্যাস্ত্রোর। তার পিতা ছিলেন আখের খামারি। দরিদ্র শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ছোটবেলা থেকেই কাজ করেছেন ক্যাস্ত্রো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিজের বাবার আখের খামারে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করে একটি ধর্মঘটের আয়োজন করেছিলেন তিনি।
অসচ্ছলতার মাঝে একটি জেসুইট বোর্ডিং স্কুল থেকে আইনের ¯œাতক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন। এরপরই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসচ্ছলতা দূর করতে হাভানায় একজন আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবনের সূচনা করেছিলেন ফিদেল। আইন পেশায় দরিদ্র মক্কেলদের পক্ষে লড়ে অল্প দিনের মধ্যেই ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন তিনি।
হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময় প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে নিবন্ধ লিখে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে নবগঠিত কিউবান পিপলস পার্টিতে যোগ দেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো।
তুখোড় বক্তা ক্যাস্ত্রো মার্কিন ব্যবসায়ী শ্রেণি ও সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবিচার, দারিদ্র, বেকারত্ব ও নি¤œ মজুরির অভিযোগ নিয়ে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে দলের তরুণ সদস্যদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি প্রথমবারের মতো দলীয় কংগ্রেসের সদস্য প্রার্থী হন। নির্বাচনে পিপলস পার্টি যখন বিজয়ের ঠিক দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই জেনারেল বাতিস্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার ক্ষমতা দখল করেন ফলে নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়।
সামরিক স্বৈরাচারকে হঠাতে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জন করার প্রত্যয়ে মাত্র ১২৩ জন নারী পুরুষের একটি সশস্ত্র দল নিয়ে ১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণ করেন। সংঘর্ষে ৮ জন নিহত হয়। ফিদেলসহ অন্যরা পরাস্ত হয়ে কারারুদ্ধ হন। মনকাডা আর্মি ব্যারাকে হামলার ‘বিদ্রোহীদের আটক করা মাত্র হত্যা’ করার নির্দেশ জারি করেন বাতিস্তা। এই আদেশে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর প্রায় ৮০জন সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হলেও ফিদেলকে আটককারী লেফট্যানেন্ট বাতিস্তার নির্দেশ উপেক্ষা করে তাকে বেসামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এতে করে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। পরর্তীতে কারাগারে তাকে বিষ খাইয়ে হত্যার জন্যে বাতিস্তা দায়িত্ব প্রদান করেন ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে। কিন্তু পেলেতিয়ার দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। এই বিরুদ্ধচারণের জন্য কোর্ট মার্শালে ফাঁসি দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন পেলেতিয়ারকে। বিশ্ব জনমতের কথা বিবেচনা করে পরে ক্যাস্ত্রোকে হত্যা না করে বিচারের মুখোমুখি করেন বাতিস্তা। মনকাডা হামলার ঐ বিচারে তার ১৫ বছরের কারাদন্ড হলেও প্রবল জনসমর্থনের কারণে মাত্র দুই বছরের মাথায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন বাতিস্তা সরকার। ২ বছর জেল খেটে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ভাই রাউল ক্যাস্ত্রোর মাধ্যমে বিপ্লবী চে গুয়েভারার সাথে পরিচয় হয় ফিদেল কাস্ত্রোর। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন গুয়েভারাকে ‘ক্যাস্ত্রোর মস্তিস্ক’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।
কিউবা বিপ্লব ও বিপ্লবের পরিকল্পনায় ক্যাস্ত্রোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালানো। সে লক্ষ্যেকে সামনে রেখেই চে গুয়েভারারকে সঙ্গে নিয়েই গেরিলা দল গড়ে তোলার জন্যে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল। সেখানে একটি গেরিলা দল গঠন এবং পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র জোগাড়ের পর চে গুয়েভারা, জুয়ান আলমেইডাসহ প্রায় ৮০ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে ১৯৫৬ সালে কিউবায় ফিরে আসেন ফিদেল।
১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই মনকাডার সেই হামলার নামানুসারে ফিদেল কাস্ত্রো নেতৃত্বাধীন গেরিলা দল ‘জুলাই টুয়েন্টি সিক্স মুভমেন্ট’ হিসেবে গোটা কিউবা জুড়ে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি বাতিস্তার প্রায় হাজার খানেক সেনা গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারালে যুক্তরাষ্ট্র বিমান, বোমা, জাহাজ ও ট্যাংক পাঠিয়ে গেরিলাদের দমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তৎকালীন নাপাম বোমার মতো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও গেরিলাদের সঙ্গে পেরে না ওঠায় বাতিস্তাকে নির্বাচন দেওয়ার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৫৮ সালের মার্চে বাতিস্তা কিউবাতে নির্বাচন দিলেও সে দেশের জনগণ ওই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। ফিদেলের সেনারা চারদিক দিয়ে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ফেলা শুরু করলে ১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল বাতিস্তা। পরে ৯ জানুয়ারি রাজধানী হাভানায় ঢুকে দেশের নিয়ন্ত্রণভার নেন ফিদেল ক্যাস্ত্রোর গেরিলারা। আর এরই মধ্যো দিয়ে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিদেল।
এই আজীবন বিপ্লবী ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ কিউবার সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হন এবং কিউবাকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৬ সালে কিউবার প্রেসিডেন্ট অফ দ্য কাউন্সিল অফ স্টেটস এবং কাউন্সিল অফ দ্য মিনিস্টারস নির্বাচিত হন তিনি। একইসঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশ পরিচালনার দীর্ঘ সময়ে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিনি আগ্রাসন থেকে কিউবাকে রক্ষায় এক অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন ফিদেল। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছোটভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত তিনি দেশকে আগলে রাখেন শিশুসন্তানের মতো।
ফিদেল তার রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক সময় অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব সিদ্ধান্তের সমালোচনা হয়েছে। তবে তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমাকে ঘৃণা কর, কোনো সমস্যা নেই; তবে দেশের কল্যাণে যেসব সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই নিরিখে ইতিহাস আমাকে মার্জনা করবে।’
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে তিনি তার কমিউনিস্ট শাসনের নানা নীতির পরিবর্তন করেছেন। মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে কিউবা। তখন তিনি ভেনেজুয়েলার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সেই পরিস্থিতি সামাল দেন।
এ বছরই ৯০ বসন্ত পেরোনে ফিদেল কিউবার কংগ্রেসে দেওয়া এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি শিগগিরই মারা যাব। তবে আমার বিপ্লবী চিন্তাধারা যেন শতাব্দীব্যাপী বেঁচে থাকে।’ ক্যাস্ত্রা পরবর্তী কিউবা কোন পথে চলে এখন সেটাই দেখার বিষয়।