এডভোকেট মলয় চক্রবর্ত্তী রাজু ::
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এদের একজনকে তাঁর খাবার রান্নার দায়িত্বে রেখেছেন। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরই একজন। এগুলোর তেমন প্রচারণা নেই বলে আমরা তাদের নিয়ে ভুল ধারণায় মজে আছি। সিনেমাতে তাদেরকে নেগেটিভ রোলেই বেশি দেখা যায়। থাকার জায়গা নেই, সরকারি চাকরিতে কোটা নেই সর্বোপরি জনগণনায়ও তাদের শুমারী করা হয় না। এতো অবহেলা, অবিশ্বাস, ঘৃণা- তারপরও রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে তাদের আনন্দময় উপস্থিতি। লোকজন বিরক্তি নিয়ে তাদের চাঁদা দিচ্ছে, গালাগালি হজম করছে- এই দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু কেউ কি কোনদিন এই বিরক্তি-ঘৃণাকে দূরে ঠেলে তাদের কাছে ডেকেছে, দুটো কথা বলেছে ভালবেসে? করেনি। যুগ যুগ এই অপমান আর অবহেলায় বেড়ে উঠে বৃহন্নলা বা হিজড়া। কিন্তু তারা আমাদের এই সমাজেরই মানুষ, আমাদেরই মতো কোন স্নেহময় পিতা-মাতার ভালবাসার ফসল।
কিন্তু পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকালে তাদের এমন লজ্জাক্কর অবস্থা ছিল বলে মনে হয় না। যেমন, মহাভারতে আছে অর্জুনের কথা। মহাবীর ছিলেন পাশাপাশি ‘সজ্জাপ্রেমী পুরুষ’ও ছিলেন। নারী সেজে প্রিয়সখা কৃষ্ণকেও বোকা বানিয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতে হিজড়াদের ‘কিছুটা ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন’ মানুষ ভাবা হতো। বলা হতো সন্তান ধারণে অন্যদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তারা নিজেদের সক্ষমতাকে বিসর্জন দিয়েছেন। হাজার বছর আগে মিশরে ফারাও রাজাদের বিশ্বাসী প্রহরী হিজড়া বা খোঁজারাই থাকতেন। মুঘলদের রাজসভায় যুদ্ধবিদ্যা, মন্ত্রণাদানের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও ছিলেন এরা। মুঘলদের প্রতিপত্তি শেষের সাথে সাথে তাদেরও সামাজিক অবস্থানের অবনতি শুরু হয়। একপর্যায়ে খানসামা, গৃহভৃত্য ইত্যাদি কাজে নেমে পড়েন তারা। ব্রিটিশরা আসার পর এই সংস্কৃতির মানুুষদের অবস্থা একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ায় তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে পড়ে আর সমাজে তাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক হতে থাকে।
‘হিজড়া’ একটি ফারসি শব্দ। ‘হিচ’ মানে টেনে আনা, ‘গাহ’ মানে গৃহ; ‘হিচ্গাহ’ হলো যাকে বাড়ি থেকে টেনে বের করে আনা হয়েছে। আমরা সাহিত্যে ব্যবহার করি ‘বৃহন্নলা’ বলে। এরা নিজেদের নারী বা পুরুষ হিসেবে পরিচয় দেয় না। তারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী নন বরং বলা যায় লিঙ্গ বৈচিত্রের মানুষ। একজন স্বাভাবিক মানুষের যেরকম মেধা-দক্ষতা থাকে, হিজড়ারাও তেমনি। সুযোগ পেলে তারাও সমাজের আট-দশটা মানুষের মতো বিভিন্ন পেশায় সাবলীলতা দেখাতে পারে।
পাশ্চাত্যে হিজড়াদের চিহ্নিত করা হয় ‘হার্মফ্রোডাইট’ হিসেবে অর্থাৎ উভলিঙ্গ। উভলিঙ্গের আবার দু’ভাগ। প্রকৃত আর অপ্রকৃত। যখন একই শরীরে স্ত্রী-পুুরুষ যৌনাঙ্গের সহাবস্থান থাকে তখন তা প্রকৃত উভলিঙ্গ আর না থাকলে অপ্রকৃত উভলিঙ্গ। সাধারণত: প্রকৃত উভলিঙ্গ খুব কম দেখা যায়। বেশি অপ্রকৃত। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে না গিয়ে খুব সংক্ষেপে বলা যায় এরা দেহে পুরুষ বা মেয়ে থাকলেও মানসিকভাবে এর উল্টো। যেমন পুুরুষ দেহের একজন হিজড়া নিজেকে নারী বলে ভাবতে ভালবাসেন এবং সেইমতো আচরণ করতেও তার মন চায়, তিনি তা করেনও। এরা কেবল ‘যৌনাঙ্গের গঠন অনুযায়ী’ লিঙ্গ নির্ধারণের সনাতনী ধারণাকে মেনে নিতে পারেন না বরং বিপরীত সাংস্কৃতিক বা মানসিক লিঙ্গের সদস্য হতে চান। তারা মনে করেন তাদের দেহের বাহ্যিক কাঠামোটি সঠিক নয়। নিজেকে তাই তার পছন্দমতো চরিত্রেই সমাজের সামনে উপস্থাপন করেন, সমাজ মানলো কি মানলোনা তার তোয়াক্কা না করেই। আর তখনই জন্ম নেয় এক অনিবার্য ট্র্যাজেডির। ছোটবেলার পরিচয় মুছে যাওয়ার সাথে সাথে আলগা হতে থাকে পারিবারিক বন্ধন। আপনজনদের আচরণ, অবজ্ঞা অসহ্য মনে হতে থাকে তার নতুন মানব পরিচয়ে। এভাবে পরিবার থেকে নিজে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে মানসিকভাবে। নিজের মানুষের খোঁজে একদিন বেরিয়ে পড়ে সে। নিয়তি তার ফেরার পথটাও বন্ধ করে দেয়। তখন তার পরিচয় হয়ে যায় ‘হিজড়া’ বলে। কোথায় যাবে সে? গন্তব্য ঠিক করাই থাকে। যেখানে তার মতো আরো দুর্ভাগা আগেই একসঙ্গে জীবন যাপনকে মেনে নিয়েছে। আরেকজন দুর্ভাগা হিসেবে সেও তাদের সাথে মিশে যায়। সেখানে অন্যরকম সামাজিক নিয়ম, সমাজ, শাসন- এক নতুন সংস্কৃতি।
নিজেদের উদ্ভাবিত ৩৭৭ ধারা ব্রিটিশরা বিলোপ করে তাদের কাছে টেনেছে। উন্নত দেশগুলোতে হিজড়া বা বৃহন্নলাদের সমাজে স্থান দিলেও এই উপমহাদেশে সমাজের মূল ¯্রােতে তারা এখনো অস্পৃশ্য। তারপরও ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে এদের জন্য কল্যাণ বোর্ড করা হয়েছে। পড়াশোনার বিশেষ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থায় বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোতে চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। সংসদ সদস্য আছেন অনেকে। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের স্বীকৃতি দিয়েছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এই সমাজের কেউ কেউ। ২০১৪ সালে সিন্ধু সরকার করাচিতে হিজড়াদের জন্য বড় পরিসরের একটি কমিউনিটি সেন্টার অনুদান হিসেবে দিয়েছে। নেপালেও তৃতীয় লিঙ্গের জনশুমারী হয়েছে। স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষার কারিকুলামে হিজড়াদের বিষয় যুক্ত করা সহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। বয়স্ক হিজড়াদের জন্য বয়স্কভাতা, শিশুদের শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, ‘জয়িতা পুরস্কার’ ইত্যাদি নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। এছাড়া হিজড়াদের সহমর্মী একজন মানুষ, সালেহ্ আহমদ, ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আরো বড় পরিসরে কাজ করার জন্য গঠন করেছেন ‘বন্ধু সোশাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’। এই ‘বন্ধু সোশাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র মাধ্যমে তিনি ও তার সহকর্মীরা নিরবে হিজড়াদের আইনী সহায়তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে কাজ করে যাচ্ছেন। অন্যান্যরাও আছেন। তারপরও তাদের আঁধার যেন কাটতেই চাইছে না। এখনো হিজড়ারা আমাদের পাশে থেকেও এক বিচ্ছিন্ন ‘দূর দ্বীপবাসীনী’। এখনো এ সংস্কৃতির মানুষদের প্রতিদিনই দেখি রাস্তায়, বিয়ে বাড়িতে দলবদ্ধভাবে গলার রগ উঁচু করে কথা বলতে। আগের সেই অভিমানী চোখ নেই, একটা উদ্ধতভাব। অথচ এদের একজনকে নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য রকম।
কয়েক বছর আগেও উনাকে দেখতাম। একা হেঁটে যাচ্ছেন। তখন সুনামগঞ্জ শহরে হিজড়াদের চলাফেরা খুব একটা ছিল না। তিনিই ছিলেন একজন। আমরা তাকে বলতাম ‘গুড়মা’। পরে জেনেছি শব্দটা হবে ‘গুরুমা’। উনাকে দেখতাম কোন কোন বাসার বিয়েতে নাচতে। কেমন যেন ঠেকতো। পুরুষের মতো লোকটা শাড়ি পরে বেণী করে নাচতে দেখে অন্যরকম ঠেকতো। তবে তার চোখে একাকীত্বের দীর্ঘ রাত দেখতাম। যেন তার কোথাও কেউ নেই। নষ্ট কিছু মানুষ উৎকট আনন্দ পেতে তাকে আরো চাইতো। তিনি হাসিতে আশ্বস্ত করতেন তাদের। তারপর যখন রাত গভীর, সবার চোখে ঘুম- মুখের রঙ না মুছেই ‘গুরুমা’ অন্ধকারে পা বাড়াতেন। বাড়ি ফিরতে। বৃষ্টি ভেজা বা কুয়াশা ঢাকা রাত্রি যখন তার পথচলাকে কঠিন করে দিতো তিনি দমে যেতেন না। এখানে তার আর স্থান নেই। তার জায়গা অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে- যেখানে পৃথিবীর সব রঙ মুছে যায়। তাদের কাছে তিনি ফিরে যেতেন। আমরা তার কোন খোঁজই রাখতাম না।
সৃষ্টির এই বিচিত্রতা হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারছিনা বলে এই বৃহন্নলাদের আমরা কাছে রাখতে কিংবা টানতে পারিনা। দূরে ঠেলে দিই। ব্রিটিশরা তাদের করা আইন নিজেরাই বিলোপ করলেও আমরা মেনে চলছি। পাশ্চাত্য তাদের মেনে নিয়েছে। আমরা তেমনভাবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারিনি। তাই এই একই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষগুলোকে আপন করতে ভয় হয়। এই ভয় আমরা প্রকাশ করি কি বিশ্রীভাবে তা এই বৃহন্নলা কবির কবিতায় প্রকট হয়-
যখন ঠোঁটের ওপর কচি গোঁফের রেখা
হাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরা,
ক্লাস নাইনে স্যার একদিন ক্লাসে এসে বললেনÑ
ফুটবল ম্যাচ হবে, কে কে খেলবি?
অনির্বাণ বললো, কী রে খেলবি নাকি?
স্যার সবার সামনে হেসে বললেন, ও তো মাইচা, ও কী খেলবে
সবাই হেসে উঠলো জোরে, স্যারও হাসলেন জোরে।
আমাদের স্কুলের গেটের সামনে যে শিউলি গাছটা ছিল
সেদিন সে তার সব ফুল ঝরিয়েছিল।