মাসুম হেলাল ::
সুনামগঞ্জে মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত স্কুল-কলেজ না থাকা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে চরম জনবল সংকট থাকায় সন্তানকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতে শহর ছেড়ে অন্যত্র পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক অভিভাবক। পাঁচ-সাত বছর ধরে শুরু হওয়া এই প্রবণতা বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। সন্তানকে বাইরে নিয়ে পড়ানোর সুযোগ যাদের নেই, তারাও রয়েছেন বিপাকে- মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিমাসে তাদেরকে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হচ্ছে প্রাইভেট টিউটর কিংবা কোচিং সেন্টারের পেছনে।
সন্তানের সুশিক্ষার জন্য শহর ছাড়ার ফলে অনেক পরিবার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলেও নিজের সামর্থ্যরে সাথে লড়াই করে কোনোমতে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন ভোক্তভোগী অভিভাবকরা। ফলে এর সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবারের উপর। অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং শিক্ষকের শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণ করলে পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে বলে মত দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। সেইসাথে জেলার বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজসহ অনার্স পড়ানো সম্ভব এমন কলেজগুলোতে অনার্সে নতুন নতুন বিষয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালু করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা। জেলা শহরে আরো ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক আরো দুটি মাধ্যমিক স্কুল সরকারিকরণ প্রয়োজন রয়েছে জানানো হয়েছে।
জানা যায়, জেলা শহরের দুই সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে রয়েছে চরম জনবল সংকট। ১৬০০ ছাত্র থাকা সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫২ জন শিক্ষকের মধ্যে ১৭ জনের পদ শূন্য। এছাড়া অতিরিক্ত ছয়টি ক্লাসের বিপরীতে কোন শিক্ষক নেই প্রতিষ্ঠানটিতে। তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান হয় এই প্রতিষ্ঠানে। একই অবস্থা সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েরও। ১২০০ ছাত্রীর এই প্রতিষ্ঠানে ৫২ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন ২৮ জন। বাকিটা চলে জোড়াতালি দিয়ে। বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মানের প্রতিফলিত হয় প্রতিবছরের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের পর। প্রত্যাশা অনুযায়ী পড়াশোনার সুযোগ অনেকটাই সীমিত সেগুলোতে।
সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফয়েজুর রহমান বলেন, শিক্ষক সংকটের কারণে ছাত্রদের লেখাপড়ার মান কমাটাই স্বাভাবিক। সীমিত জনবল দিয়ে আমরা ভাল করার চেষ্টা করছি।
এদিকে, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়াশোনা করে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিক,স্নাতক পাস কোর্সের পাশাপাশি ১২টি বিষয়ে অনার্স চালু রয়েছে জেলার বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। এর বিপরীতে ৫০ জন সরকারি শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র সাত জন। এই সাত জন শিক্ষকের পাশাপাশি কলেজের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে চলছে হাওর অধ্যুষিত শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা জেলার উচ্চশিক্ষার কার্যক্রম।
অভিভাবকরা জানান, প্রাথমিক পর্যায় থেকে সুনামগঞ্জের যেসব অভিভাবক তার সন্তানকে মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান- এখানকার বাস্তবতায় তাদের জন্য সেই সুযোগ সীমিত। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গৎবাঁধা নিয়মে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। এর বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিন্ডারগার্টেনগুলোতেও সেই অর্থে মানসম্পন্ন পড়াশোনা খুব একটা হয় না। কাজেই মানসম্পন্ন শিক্ষার নিশ্চিত করতে সন্তানের শিক্ষাজীবনের শুরুতেই বিকল্প ভাবতে হচ্ছে অনেককে।
সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া বাগানবাড়ি এলাকার বাসিন্দা দেওয়ান মোবাশ্বির রাজা চৌধুরী সুজন বলেন, আমার দুই সন্তানকে সিলেটের আনন্দ নিকেতন স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। শহরে মানসম্পন্ন স্কুল না থাকায় কেবল সন্তানের পড়াশোনার জন্য বাসাবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে সিলেটে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। শহরে যদি ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতো তবে আমার মতো অনেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হতো না।
অপরদিকে, মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করা সন্তানের অভিভাবকরা রয়েছেন আরো বিপাকে। জেলা সদরে অবস্থিত ‘ভাল’ হিসেবে পরিচিত দুটি সরকারি স্কুল- সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সীমিত আসনসংখ্যা পূর্ণ হওয়ার পর সুযোগ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভাল পড়াশোনার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ, ‘ভাল’ হিসেবে পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটিতেও শিক্ষক সংকটের কারণে গত কয়েক বছর ধরে বোর্ড পরীক্ষায় ফলাফলে ক্ষেত্রে বিভাগীয় পর্যায়ে তলানিতে অবস্থান করে আসছে। শিক্ষার সুযোগের এই প্রতিক‚ল পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেখানে বিকল্প সুযোগ রয়েছে সেখানে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না অভিভাবকদের।
এদিকে, শিক্ষকের চরম সংকটের কারণে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে মানসম্পন্ন পড়াশোনা নিশ্চিত না হাওয়ায় কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে এমন অনেক অভিভাবক সিলেট কিংবা ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কর্মস্থল সুনামগঞ্জ থাকার পরও বাইরে থাকার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। সুনামগঞ্জে কর্মরত আইনজীবী, সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের অনেক অভিভাবক সন্তানের মঙ্গলের জন্য এই বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল হক জানান, আমি উকালতি করি সুনামগঞ্জে। কিন্তু সন্তানদের ভাল কলেজে পড়াশোনা করানোর জন্য আমাকে সিলেটে থাকতে হচ্ছে। জেলার একটি মাত্র বড় কলেজে শিক্ষক নাই। এসএসসি পাস করার পর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে আগের ফলাফল ধরে রাখতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। কাজেই সন্তানের ভাল পড়াশোনার কথা বিবেচনা করে বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে সিলেটে থাকছি।
তার মতো আরো অন্তত ২০ জন আইনজীবী সন্তানদের লেখাপড়া করতে সিলেটে বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ অবস্থান করছেন বলে জানান তিনি।
আব্দুল হক আরো বলেন, বিকল্প এই পথ বেছে নেওয়ার সীমাহীন কষ্টের মধ্যে আছি। প্রতিদিন সিলেট থেকে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলের হুইপ অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষাখাত উন্নয়নের জন্য প্রচুর বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুনামগঞ্জে চরম শিক্ষক সংকট থাকার কারণে প্রত্যাশিত ফলাফল পাচ্ছি না আমরা। কেবলমাত্র বহুতল একাডেমিক ভবন নির্মাণ করে দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়, এটা নিশ্চিত করতে হলে পর্যাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। আমি এই বিষয়টি বার বার নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে নিয়ে এসেছি। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জে আরো ভালমানের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। সেটা না করলে সন্তানের মঙ্গলের আশায় সীমাবদ্ধতার মাঝেও অভিভাবকরা অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হবেন।