বাংলাদেশ ছাত্রলীগ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা শান্তি প্রগতির মন্ত্রে গঠন করেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জন্মই হয়েছে বাংলা এবং বাঙালির প্রতিটি সংকট-সংশয়ে সংগ্রামী সারথী হওয়ার জন্য। আজন্ম বিপ্লবী বাঙালি জাতির প্রতিবাদের মশাল হাতে অগ্রসরমান সৈনিকের সাংগঠনিক পরিচয় তালাশ করলে যে নামটি ভেসে উঠে সেই নামটি ইতিহাসের দায় মেটানোর রক্তে ভেজা ছাত্রলীগ।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শিক্ষার সাথে শান্তির, প্রগতির সাথে মুক্তির সংমিশ্রণে ৭২ বছরে পা বাড়িয়েছে। যৌবনের মানবীয় উন্মাদনা আর যাবতীয় উত্তাপে সকল লোভ-লালসাকে পাশ কাটিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে প্রতিবাদের ডাক জুড়ে দেয় যারা তারাই ইতিহাসের গৌরবান্বিত সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র এবং ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে গড়ে উঠা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদের পক্ষে ছয় দফার গুরুত্ব গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা নিয়ে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে মতবিভেদ থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল অনড় যার কারণে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১৯৭০ সালের বাঙালির বহুল আকাক্সিক্ষত ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর হাড়ভাঙা খাটুনিতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় ঘরে তুলে।
৩ মার্চ ১৯৭১ তৎকালীন পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ছাত্র জনসভায় আকস্মিকভাবে উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সভায় বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সেদিনই সভা থেকে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ গ্রহণ করেন। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে বাঙালি জাতির জন্মযুদ্ধের সূচনা হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি নরপিশাচ শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ১৭ হাজার নেতাকর্মী প্রাণ দান করেন যা সংগঠন হিসেবে আর কোনো সংগঠনের একসাথে এতো প্রাণ দেয়ার ইতিহাস নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির সবথেকে কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়, হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের ২৬ সদস্যকে। খন্দকার মোশতাক চক্রের সকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে গ্রামে গঞ্জে মুজিব হত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকে ছাত্রলীগ।
১৯৮১ সালের ১৭ মে পিতা মুজিব বিহীন বাংলাদেশে তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ফিরে এলে ছাত্রলীগ ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করে। ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগ গ্রামে গঞ্জে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ১৯৯৮ সালের বন্যাসহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একই কার্যক্রম নিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল ছাত্রলীগ।
২০০২ সালের ২৩ জুলাই জামাত-বিএনপির পেটোয়া পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রদলের ক্যাডাররা গভীর রাতে শামসুন্নাহার হলে ঢুকে ছাত্রীদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। ছাত্রলীগ সেদিন শামসুন্নাহার হলের ছাত্রীদের সম্ভ্রমহানির হাত থেকে রক্ষা করে ও দোষীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বিতর্কিত সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে আটক হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সেদিন সকল বাধা উপেক্ষা করে ছাত্রলীগই প্রথম নেত্রীর মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে। পরবর্তীতে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের নেপথ্যে অজস্র ছাত্রলীগ কর্মীর নিঃস্বার্থ শ্রম-ঘাম রয়েছে।
ছাত্রলীগের সব থেকে বড় অর্জন যদি বিবেচনা করা হয় সবথেকে উজ্জ্বল যে অর্জন ছাত্রলীগের কর্মী থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তাই হয়তো পিতা মুজিব বলেছিলেন ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস’।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে জানাই মুজিবীয় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
[জগৎজ্যোতি রায় জয়, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ]