বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে মানুষ প্রযুক্তির সান্নিধ্যেই থাকতে চায়। মুহূর্তেই দেশে-বিদেশে তথ্য আদান-প্রদান করতে চায়। প্রযুক্তির সকল মাধ্যমগুলোর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো এখন বেশ জনপ্রিয়। দিন দিন এর ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের অনেক সাইট থাকলেও আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যাই বেশি। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সৃজনশীল তরুণ মার্ক জুকারবার্গের হাত ধরেই ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর থেকেই বিশ্বব্যাপী ফেসবুকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। জানা যায় আমাদের দেশেও প্রতি বারো সেকেন্ডে একটি ফেসবুক আইডি খোলা হচ্ছে। এতেই প্রমাণিত হচ্ছে যে মানুষ কত দ্রুত গতিতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যুক্ত হচ্ছে। এখন ছেলে বুড়ো, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান সবাই এই ফেসবুক আইডিতে যুক্ত। শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সেটা সমস্যা নেই। শুধু একটি স্মার্ট ফোন কিনে তারা ফেসবুকে একটি আইডি খোলে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকের কাছে এটা আবার আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষিত ও সচেতন ব্যক্তিবর্গ ফেসবুকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যাগুলোতে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করছেন। তবে সরকারি চাকরিজীবীদের ফেসবুক ব্যবহারে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের ফেসবুক ব্যবহারে একটি নীতিমালা রয়েছে। দেশে সামাজিক আন্দোলনে ফেসবুক বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ফেসবুক ব্যবহারকারীরা দেশে-বিদেশে অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তুলেন। এখন দেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ফেসবুকে একটি স্টেটাসের মাধ্যমে। ফেনীতে মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা, কুমিল্লায় তনু হত্যা, বুয়েটে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ফেসবুকের মাধ্যমে দেশবাসী তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ২০১৫ সালে সিলেটে শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ফেসবুকে দেশবাসী তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। পরে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সৌদিতে আটক করা হয়। দুর্নীতির বিষয়ে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ হবার পরপরই সচেতন ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। জামালপুরের জেলা প্রশাসক তার কার্যালয়ে কর্মরত নারী কর্মচারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ প্রকাশ হবার পরেই দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ফেসবুকে দেশবাসীর প্রতিবাদের মুখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়ে তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। ফেসবুকে ঝড় উঠে এসব অন্যায়ে, অনিয়মে। অতিসম্প্রতি সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে বিআরটিসি বাস চালু রাখার দাবিতে ফেসবুকে বেশ জোরালো প্রতিবাদ হয়েছিল। সুনামগঞ্জে দিরাইয়ে বাবা কর্তৃক শিশু হত্যার অভিযোগে ফেসবুকে বেশ তীব্র প্রতিবাদ হয়। হত্যাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়। বেশ কয়েক বছর পূর্বে মিসরে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়েছিল এক যুবকের আহ্বানে। তিনি ফেসবুকে স্টেটাসের মাধ্যমে এই আহ্বান করেছিলেন। একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ স্বরে আওয়াজ করলে কিছু দূর পর্যন্ত লোকজন শুনতে পাবে। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদে ন্যায্য দাবি আদায়ে ফেসবুকের একটি স্টেটাসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জানানো সম্ভব।
বর্তমান সময়ে ফেসবুককে গুজব ছড়ানোর কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে শক্তভাবে। অতিসম্প্রতি দেশে কয়েকটি গুজব ফেসবুকে ছড়ানো হয়েছিল। পদ¥া সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা প্রয়োজন। তাই একদল লোক নাকি দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মাথা কাটার জন্যে। এ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে ফেসবুকে একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকদিন পূর্বে লবণের দাম বৃদ্ধি নিয়ে ফেসবুকে একটি গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ গুজবে সাড়া দিয়ে অনেকেই রাতেই ১৫/২০ কেজি লবণ কিনে ঘরে মজুত রেখেছেন। এ গুজবে শুধুমাত্র অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত ব্যক্তিরাই নন, শিক্ষিত ব্যক্তিরাও কান দিয়েছেন। ফেসবুকের স্টেটাসের সূত্র ধরেই দেশে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও পরিলক্ষিত হয়েছে। ভোলায় বোরহানউদ্দিনে এমনই এক ঘটনায় চার জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে ফেসবুকের সূত্র ধরেই ১৯টি মন্দির ধ্বংস করা হয়। এটা সাধারণত ফেইক আইডি বা হ্যাকড করা আইডি থেকেই ঘটে থাকে।
ফেসবুককে অনেকেই সময় কাটানোর জন্যে ব্যবহার করেন। নিজের ঘরের খবরাখবর জানিয়ে এবং সেলফি আপলোড করে অনেকেই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন। প্রায়ই অনেকেই বলে থাকেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো মানুষকে অসামাজিক করে তুলছে। ভার্চুয়াল জগতে বেশি সময় পার করায় নিজ পরিবার-পরিজনকে সময় দিতে পারছেন না। এসব সাইটে অনেক দুর্ঘটনাও ঘটছে। অনেকেই ফেইক আইডি দ্বারা অসৎ উদ্দেশ্য সাধন করে।
প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুটোই আছে। আমাদের মন্দটাকে পরিহার করে ভালটাকে গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি যারা মন্দটাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন তাদেরকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বিশেষ করে স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাবা, মা, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাইকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ফেসবুকের নেতিবাচক ব্যবহারের কারণেই এই বয়সের ছেলে-মেয়ে, নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কিছুদিন পূর্বে আমার এক প্রিয় লেখক ও সাংবাদিক তাঁর ফেসবুক আইডিতে মুখে সিগারেট নিয়ে নিজের একটি ছবি আপলোড করেছেন। এতে অনেকেই বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এসব সমালোচনার জবাবে তিনি বললেন তিনি জীবনটাকে খোলা বইয়ের মতন রাখতে চান বলে সব কিছুই স্পষ্ট করে তুলে ধরতে চান। ভালোর পাশাপাশি মন্দটাকেও তিনি সবার সাথে শেয়ার করতে চান। আমার প্রিয় ব্যক্তির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা রেখে বিনয়ের সাথে বলতে চাই- আমরা সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে গেলে সবচেয়ে ভালো পোশাকটিই পরে যাই। সেখানে কেউ রাতে ঘুমানোর পোশাক পরে যাই না। তেমনি আমাদের নিজের মন্দ দিকগুলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
সমাজে, রাষ্ট্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে অনেকেই মডেল বা আইডল হিসেবে ধরে তাঁকে অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। তখন আইডলদের মন্দ দিকটা দেখলে খারাপ লাগবে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম এটাকে অনুসরণ করে। তাই ফেসবুকের মত বিশাল একটি প্লাটফর্মে একটি স্টেটাস নিজের মেধা, বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
বর্তমান শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম সোস্যাল মিডিয়াতে বেশ সক্রিয় এবং এই মাধ্যম ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে। বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষের জন্যে কাজ করে যাচ্ছে। নিজ এলাকার শিক্ষা, সাহিত্য, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক কর্মকা-ে জড়িত হচ্ছে। ফেসবুকের মত এই মাধ্যমের কারণেই এসব কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি বিপরীত চিত্রটাও উদ্বেগজনক। ফেসবুককে অনেকেই নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করছেন। এটা অন্যায়, নোংরামি বা হীন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন। আমাদের দেশে অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম ফেসবুক ব্যবহারের উদ্দেশ্য বা নীতিমালা না জানার কারণে দেশে বিদ্যমান তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় অভিযুক্ত হয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। প্রায়ই এ বিষয়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তারা ফেইক আইডির দ্বারা প্রতি মুহূর্তেই হীন উদ্দেশ্যে ধর্মীয় উস্কানিমূলক, রাজনৈতিক বা সমাজের বিভিন্ন পেশার সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে হেয় করার জন্যে নোংরা, বানোয়াট স্টেটাস ও সাথে আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে। এ ব্যাপারে সচেতন ব্যক্তিবর্গ বা শিক্ষিত তরুণ সমাজকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদেরকে সচেতন করার জন্যে সময় ও সুযোগ সাপেক্ষে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে এবং সমাজে বা রাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতি সেকেন্ড ফেসবুকে লক্ষ লক্ষ স্টেটাস দেয়া হচ্ছে, ছবি আপলোড করা করা হচ্ছে। এর মধ্যে সামাজিক সচেতনতামূলক বা রাষ্ট্রের কল্যাণে স্টেটাস বা পোস্টের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আমাদের দেশে এই মাধ্যমে মেয়েরা স্বাধীনভাবে যুক্ত হতে পারছে না। ফলে অনেক মেয়ে বা নারীর ফেসবুকের মত জনপ্রিয় উপকারি এই মাধ্যমের প্রতি রয়েছে বিরূপ ধারণা। অনেকেই মনে করেন এটা একটি খারাপ মানুষের স্থান। ভালো মানুষেরা ফেসবুক ব্যবহার করেন না। আমার মতে ফেসবুকের ভাল মন্দ নির্ভর করে কে কিভাবে এটাকে ব্যবহার করছেন সেটার উপর।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যদি ভালো থাকে তাহলে আমরা এর সুফল পাব। একটি আলোকিত সমাজ, কল্যাণময় রাষ্ট্র গঠনে প্রতিটি নাগরিকের ভূমিকা থাকে। একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আসুন আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে নিজের ভালোলাগা, অর্জন, সুখের মুহূর্তগুলো সবার সাথে শেয়ার করার পাশাপাশি সমাজের, রাষ্ট্রের মন্দ, অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জানিয়ে এ মাধ্যমে তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি।
[লেখক : প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি দিগেন্দ্র বর্মণ কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ]