ক্রাইম রিপোর্টার ::
জামালগঞ্জ উপজেলার সুরমা এবং রক্তি নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে প্রকাশ্যে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। ওই নৌপথে চাঁদাবাজি রুখতে ২৮ জন নৌপুলিশের বহর থাকলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নৌপুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। তবে নৌপুলিশের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে কোনো চাঁদাবাজকে ধরা যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেতে যেতেই উৎপাতকারীরা ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, বিআইডব্লিউটিএ এবং উপজেলা পরিষদের সরকারি ইজারা নীতিমালার তোয়াক্কা না করে সুরমা ও রক্তি নদীর এই ৪০ কি.মি.-এর অধিক এলাকাজুড়ে ভৈরব বাজার নদীবন্দরের একটি কাগজ দেখিয়ে দিনদুপুরে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে প্রতিমাসে লাখ-লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে নিচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ চক্রটি। চলতি বছর জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ থেকে রুবেল মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে টেন্ডারের মাধ্যমে দুর্লভপুর খেয়াঘাট ইজারা দেয়া হয়। আর এ ঘাটের ইজারা নীতিমালায় নৌযান নোঙর করা বাবত প্রতি নৌযান থেকে ৫০ টাকা করে টোল আদায়ের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু ইজারাদার আদেশ না মেনে সুরমা ও রক্তি নদীতে যাওয়া-আসায় লোড-আনলোডের বাল্কহেড নৌযান থেকে এক হাজার টাকা থেকে দুই হাজার টাকা এবং রক্তি নদীতে প্রবেশে দুই হাজার টাকা করে আদায় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে দুর্লভপুর গ্রামের রজব আলীর ছেলে ইয়াকবির হোসেন ভৈরব-আশুগঞ্জ নদীবন্দরের একটি আদেশনামায় জামালগঞ্জের গজারিয়ায় সুরমা ও বৌলাই নদীর শাখা মোহনার উভয় তীরে মালামাল উঠা-নামাকৃত টোল আদায়ের নাম করে পরিবহনকারী পাথর ও বালুবাহী বাল্কহেড নৌযান থেকে ৫০০টাকা থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছেন। মূলত গজারিয়া পয়েন্টে কোথাও কোনো প্রকার মালামাল স্টক বা লোড-আনলোড হয় না। একটি মাত্র ছোট্ট ডিপোতে ঢাকার ব্যবসায়ী বালু জমা রাখেন। এক্ষেত্রে বার্জিং চার্জ আদায়ের নামে পয়েন্ট ইজারা দেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই বলে বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ জানান। আর এই অপ্রয়োজনীয় ইজারা প্রথার সুবাদে এই নৌরুটে গড়ে উঠেছে বেপরোয়া চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট।
স্থানীয়রা জানান, এই নদীতে চাঁদাবাজিতে যারা জড়িত তারা খুবই ভয়ঙ্কর। চাঁদাবাজদের সাথে রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধির স¤পৃক্ততা রয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
জানাযায়, সরকারের শুল্ক স্টেশন থেকে রয়েলিটিকৃত এলসির মাধ্যমে কয়লা, বালু, নুড়িপাথর, চুনাপাথর কিনে সারাদেশে জোগান দেন ব্যবসায়ীরা। এসব আমদানিকৃত পণ্য বহনের মাধ্যম জামালগঞ্জ উপজেলার এসব নদীপথ। নদীপথে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানো হয় বালু-পাথর, কয়লা ও চুনাপাথর। আর যাতায়াতের সময় নদীপথে বাল্কহেড ও ছোট বড় স্টিলবডি নৌকা চলাচলের সময় দুর্লভপুর-গজারিয়া, মান্নানঘাট নামক স্থানে এলেই নদীতে ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা দিয়ে জোর করে চাঁদা আদায় করছে দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ চক্রের হোতারা।
সঙ্ঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্রটি প্রতিদিন দুই থেকে পাঁচ শতাধিক বাল্কহেড নৌযান থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা হারে চাঁদা আদায় করে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। তাদের নিষ্ঠুরতা আর মারমুখী আচরণে মালবাহী এসব নৌযান চালকেরা আতঙ্কিত অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করেন। একাধিক ভুক্তভোগী মাঝি, চালক ও নৌযানের মালিকেরা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ভুক্তভোগীরা আরো জানান, চাঁদাবাজদের কথা মতো চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বেদম মারধর করা হয়। এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়। স্টিলবডি নৌযান চালক সজল মিয়া, আবদুস সালাম, ইদ্রিস মিয়া, লিটন মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পেট বাঁচাতে আমরা পিঠ পেতে দেই। অনেক সময় টাকা দিয়েও আমাদের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও পেটের দায়ে আর বউ-বাচ্চার খাওন জোগাতে এই পথে আসতে হয় আমাদের। চাঁদাবাজদের হাতে আমরা প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতনের শিকার হই।
সুনামগঞ্জ মালবাহী নৌযান ফেডারেশন লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, অসাধু কিছু ব্যক্তির ছত্রছায়ায় প্রতিনিয়তই এমন চাঁদাবাজি হচ্ছে। চাঁদাবাজির বন্ধের জন্য তিনি জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
বাল্কহেড কার্গো সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সুরমা ও রক্তি নদীতে কোনো ধরনের চাঁদা দাবি স¤পূর্ণ বেআইনি। বিভিন্ন সময়ে আমরা নৌযান মালিক ও শ্রমিকেরা চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েছি। এমনকি নৌপথে চাঁদাবাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গত বছর সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছিল। অভিযোগের পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে কয়েক মাস চাঁদাবাজি বন্ধ ছিল। এ বছর আবার চাঁদাবাজি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীপথে যেকোনো সময় বাল্কহেড ও কার্গো চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
চাঁদাবাজির ব্যাপারে দুর্লভপুর ঘাট ইজারাদার রুবেল মিয়া বলেন, সরকারিভাবে আমাকে যেভাবে ইজারার নিয়ম করে দেয়া হয়েছে আমি সেভাবে টোল আদায় করছি। আমি কোনো ধরনের অনিয়ম করি নাই।
গজারিয়া নদী ঘাটের ইজারাদার ইয়াকবিরের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য জানাযায়নি।
জানা গেছে, জামালগঞ্জ উপজেলা সীমানার নৌপথ নিরাপদ রাখতে জামালগঞ্জ উপজেলার মান্নানঘাট নামক স্থানে লালপুর নৌপুলিশ ফাঁড়িতে ১ জন এসআই (ইনচার্জ), ৮জন এএসআই, ১জন নায়েক এবং ১৮ জন কনস্টেবল রয়েছেন। ২৮ জন নৌপুলিশের এই বহর থাকা সত্ত্বেও চাঁদাবাজরা কিভাবে এই উৎপাত চালিয়ে আসছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট নৌপুলিশের আইসি এসআই রুহুল আমিন বলেন, আমাদের ফাঁড়িতে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট না থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে কোন চাঁদাবাজকে ধরা যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেতে যেতেই উৎপাতকারীরা ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। আমাদের ফাঁড়িতে একটি মাত্র নৌকা আছে। এই একটি মাত্র নৌকায় টহল চলাকালে প্রায় ৪০ কি.মি.-এর অধিক নৌপথে চাঁদাবাজদের আমরা পাই না। আমাদের কমপক্ষে আরো ২টি নৌকা আবশ্যক। পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট পেলে তাৎক্ষণিক চাঁদাবাজদের হাতেনাতে ধরা সম্ভব হতো। তিনি আরো বলেন, চাঁদাবাজদের ব্যাপারে আমি জামালগঞ্জ ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি।
এদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার নদী বন্দর, ভৈরব এর উপ-পরিচালক মো. আসাদুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আশুগঞ্জ-ভৈরব নিয়ন্ত্রণাধীন সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের অন্তর্গত গজারিয়া এলাকায় সুরমা নদী ও বৌলাই শাখা নদীর মোহনায় উঠানামাকৃত মালামালের এলসি ও বার্জিং চার্জ আদায় পয়েন্ট হিসেবে ২০১৮ সাল থেকে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে যদিও এই পয়েন্টে কোনো মালামাল উঠানামা তেমন নেই, তথাপি ইজারা ব্যবস্থা রয়েছে। চলতি নদীতে মালবাহী নৌযান থেকে চাঁদাবাজি বন্ধে সেখানকার নৌপুলিশ রয়েছে। তারা সক্রিয় হলে তো নৌপথে চাঁদাবাজদের উৎপাত বন্ধ হবার কথা।
জামালগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ সাইফুল আলম বলেন, গত ২১ আগস্ট গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে করা একটি মামলার তদন্ত চলছে। এছাড়াও নৌপুলিশকে এ ব্যাপারে তৎপর হতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, কারা চাঁদাবাজি করছে তাৎক্ষণিক আমাকে জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা পাল বলেন, গত ২ সেপ্টেম্বর সাচনাবাজার ইউনিয়নের দুর্লভপুর এলাকায় নৌপথে চাঁদাবাজির অভিযোগে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে একজনকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সুরমা নদীর মান্নানঘাট, গজারিয়া নামক নৌরুটে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানে নৌপুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। এই ইজারা বিষয়টি আমাদের উপজেলা পরিষদের অধীনে না। সম্ভবত বিআইডব্লিউটিএ থেকে সংশ্লিষ্টরা একটি ডকুমেন্টারি নিয়েছেন। এগুলো নিয়ন্ত্রণে নৌপুলিশও আছে। চাঁদাবাজি চলাকালে যদি হাতেনাতে ধরতে পারি তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধে অভিযান চলবে। এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ ইউএনওকে বলে দিয়েছি কোন অবস্থাতেই যেন নৌপথে চাঁদাবাজি না হয়।