একজন আইনজীবীর (এনাম আহমদ, জেলা সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক) ফেসবুক স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একজন আইনজীবী (কবি রোকেস লেইস, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি) প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লিখেছেন, ‘যাত্রী সাধারণকে যুক্তিহীন, অন্যায় কারণে যাতে জিম্মি করার সুযোগ না পায়, সর্ব পর্যায় থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে।’ এই স্ট্যাটাস কিংবা একটু বিষদ অর্থে জনসামাজিক প্রতিক্রিয়া সুনামগঞ্জের পরিবহন মালিক সমিতির আচরণকে সর্বপ্রকার নীতিনৈতিকতাবিবর্জিত বলে প্রতিপন্ন করছে এবং প্রকারান্তরে বিব্রত সাধারণ মানুষকে এই জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখিন করে তোলেছে যে, বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও পরিবহন মালিক সমিতির মধ্যে অধস্তন প্রতিষ্ঠান কোনটি? পরিবহন মালিকদের আচরণের নিহিতার্থ এই দাঁড়াচ্ছে তাঁরাই আদতে রাষ্ট্রের মালিক ও রাষ্ট্রের তৈরি সড়কের মালিক আপাতত পরিবহন মালিক সমিতি ভিন্ন অন্য কেউ নয়। অথবা সড়কে বিআরটিসি বাস চালু নিয়ে সরকার ও পরিবহন সমিতির ‘কথিত দ্বন্দ্বে’র পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতির সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে বিবেচনা করলে এই সত্য প্রতিপন্ন হয় যে, সড়ক পরিবহন সমিতির দখলে আছে। যেমন একদা ভারত ব্রিটিশদের দখলে ছিল, দখল করে নিয়ে ব্রিটিশরা ভারতের একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসেছিল। তেমনি পরিবহন মালিকও সড়কের মালিক হয়ে বসেছেন। রাষ্ট্রের ভেতরে তাঁরা অন্যধরনের বৈকল্পিক রাষ্ট্র তৈরি করেছেন এবং কার্যত সড়কের মালিক বনে বসেছেন। সুতরাং দেখেশোনে যে-কোনও সচেতন নাগরিকের মনেই হতে পারে যে, তিনি যে-রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করছেন সেখানে পরিবহন সমিতি নামের আর একটি রাষ্ট্র আছে। তা-না হলে পরিবহন সমিতি বিআরটিসি বাস চালুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রকারান্তরে সড়কের একচ্ছত্র মালিকানা দাবি করে কোন অধিকারে। তাদের এই এই দাবি কি সংবিধান সম্মত? সরকারের এই সড়কে বাস চালানোর কোনও অধিকার নেই।
গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদশিরোনাম ছিল, ‘পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যের প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন সচেতন মানুষ’। সংবাদ বিবরণীর শুরুতেই বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ-সিলেট রুটে বিআরটিসি বাস চালুর প্রতিবাদে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। যা আগামী ২৩ জুন থেকে কার্যকর হবে। সাধারণ্যের ধারণা তাদের এই ধর্মঘটের ডাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনৈতিক। এর কারণ এই যে, পরিবহন মালিকদের এই দাবির পক্ষে কোনও যুক্তিসঙ্গত সামাজিক-আর্থনীতিক কারণ ও আইনগত ভিত্তি নেই। রাষ্ট্র যেহেতু সড়কপথ পরিবহন মালিকদের কাছে নিলাম কিংবা বিক্রি করে দেয়নি, কাজেকাজেই তাদের এবংবিধ আচরণের (‘বিআরটিসি বাস সড়কে চলতে দেবো না’র বেয়াড়াপনার) ব্যাখ্যা একটাই হতে পারে। এবং সেটা হলো, তারা মনে করেন, এখনও পর্যন্ত মুক্তবাজার অর্থনীতির ভিত্তিতে যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং বিরাষ্ট্রীকরণের নীতি যেহেতু কার্যকর আছে ও মাঝে মাঝেই উৎসাহিত হয় সুতরাং রাষ্ট্র তাদের এই অন্যায় আবদার মান্য করে, তাদের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে বিআরটিসি বাস চালু করার পরিকল্পনা স্থগিত রেখে পিছিয়ে যাবে। এবং প্রকারান্তরে রাষ্ট্র যাত্রীসাধারণের উপর পরিবহন মালিক সমিতি কর্তৃক আরোপিত সর্বার্থে অনৈতিক অত্যাচার, অসদাচরণ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নি¤œমানের যাত্রীসেবা পরিবেশন করে উচ্চমানের যাত্রীসেবা পরিবেশনের ভাড়ামূল্য আদায় এইসব অন্যায় কর্মকা-ের বৈধতা প্রদান করবে। এমন উচ্চাকাক্সক্ষী পরিবহন মালিকদের নৈরাজ্যের প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন সুনামগঞ্জের সচেতন মানুষ। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী রোববার (১৬ জুন) দুপুর ২টায় জেলা আইনজীবী সমিতি ভবনে তরুণ আইনজীবীগণের উদ্যোগে পরিবহন মালিকদের নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ও বিআরটিসি বাস চালু রাখার পক্ষে মতবিনিময় সভা বসবে। আমরা জেলা আইনজীবী সমিতিকে সাধুবাদ জানাই, তাঁরা সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। আর জেলার সচেতন সাধারণ মানুষদের কাছে আবেদন করি, আপনারা রুখে দাঁড়ান। মনে রাখবেন, চেয়ে না পেলে কেড়ে খেতে হয়। আর পরিবহন মালিকেরা পরিবহন ব্যবসার নামে সারা জীবনই সাধারণ মানুষেরটা কেড়ে নিয়েছে, এবং সাধারণ মানুষ তথা যাত্রীসাধারণ একটু প্রতিবাদী হলে, বেগড়বাই করলেই নির্দ্বিধায় ও নির্মমভাবে অসদাচরণ করেছে, গায়ে হাত তোলেছে। এই অত্যাচারের প্রতিকার চাই। অন্যায়কে মেনে নেবো না। সামগ্রিক বিবেচনায় রাষ্ট্রের কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া কোনও যুক্তিতেই সমীচীন নয়, বরং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখনই তৎপর হওয়া জরুরি।
সড়কের মালিক রাষ্ট্র, বিআরটিসি বাসের মালিক রাষ্ট্র, আর রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণের রাষ্ট্রের ভেতরে জনগণের সড়কে, জনগণের বাস (বিআরটিসি বাস) চলবে। এই বাস্তবতার ভেতরে পরিবহন মালিক সমিতির কোনও যে-কোনও তৎপরতা অবৈধ ও অন্যায়। এই প্রত্যয়ে জেগে উঠো জেলাবাসী।