শামস শামীম ::
এবারও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি সুনামগঞ্জের ৩৭ হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২৮ ফেব্রুয়ারি ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারি হিসেবে নির্ধারিত দিনে এসে ৮৬ ভাগ কাজ সম্পন্ন হওয়ার দাবি করা হলেও কৃষক সংগঠন ও হাওরের কৃষকরা এই তথ্য উড়িয়ে দিয়েছেন। এদিকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে সংবাদ সম্মেলন করেছে হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন। সংগঠনটি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আগামীকাল শনিবার জেলাব্যাপী মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। বাঁধের কাজে বিলম্বের কারণে ফসলহানি ঘটলে এর দায় সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে জেলা কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি সূত্রে জানা গেছে এক সপ্তাহ ধরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কাজ করা যাচ্ছেনা। যার ফলে আরো ১৫ দিন সময় বাড়িয়ে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
হাওরের কৃষকসহ সচেতন মহল জানিয়েছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত দিনে এসে হাওরের মাত্র ৫০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সরকারি হিসাবের ৮৬ ভাগ কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন কৃষক সংগঠনের নেতারাও। হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন বাঁধের কাজে বিলম্ব হওয়ার প্রতিবাদে আগামীকাল শনিবার জেলার প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে একযোগে মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে যথাসময়ে কাজ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর অধীনে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে সুনামগঞ্জের ৩৭ হাওরের প্রায় ৪০০ কি.মি. ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৯৬ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথা বিলোপ করে কৃষকদের মাধ্যমে ৫৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের মাধ্যমে গত ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা ছিল। গণশুনানি করে বাঁধ সংলগ্ন এলাকার কৃষক ও জমির মালিকদের দিয়ে গত অক্টোবরেই পিআইসি গঠনের কথা ছিল। কিন্তু জানুয়ারির আগে কোথাও পিআইসি গঠন হয়নি। কাজও শুরু হয় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এসে। এমনকি গত সপ্তাহেও কোন কোন স্থানে কাজ শুরু হয়।
জানা গেছে, নতুন নীতিমালায় জেলা প্রশাসককে জেলা কমিটির প্রধান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের উপজেলা প্রধান করে কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি কমিটি গঠিত হয়। তাদের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিদেরও কমিটিতে যুক্ত করা হয়। শুরুতে মনিটরিং কমিটির তৎপরতা না থাকায় পিআইসিরা সংশ্লিষ্টরা কাজে গাফিলতি করে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে জেলা ও উপজেলা মনিটরিং কমিটিগুলো তৎপর হওয়ায় কাজে কিছুটা গতি আসে বলে মনে করেন কৃষকরা। এসময় কাজ আদায় করে নিতে বিভিন্ন স্থানে পিআইসি সদস্যদেরও আটক করে মুচলেকা আদায় করা হয়। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ১৫ দিন আগে সুনামগঞ্জে এসে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে বলে ঘোষণা দেন। তবে কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় গত কয়েকদিনের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও বৃষ্টিকে দায়ি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্ধারিত সময়ে এসে জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলায় হাওরের ৮৬ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদনে এখনো বাঁধের স্লোপ, কমপেকশন ও ঘাস লাগানোর কাজ এখনো চলছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সরকারি হিসেবে সদর উপজেলায় ৮৫ ভাগ, ধর্মপাশায় ৮৬ ভাগ, জামালগঞ্জে ৮৮ ভাগ, তাহিরপুরে ৮৫ ভাগ, বিশ্বম্ভরপুরে ৯০ ভাগ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ৮২ ভাগ, ছাতকে ৯০ ভাগ, জগন্নাথপুরে ৮৭ ভাগ, দোয়ারাবাজারে ৮৮ ভাগ, দিরাইয়ে ৮৮ ভাগ এবং শাল্লায় ৮৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে দবি করা হয়েছে। গড়ে ৮৬ ভাগ কাজ হয়েছে বলে জানানো হয় সরকারি ওই প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন গত এক সপ্তাহ ধরে কাজের গতি কম। বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ার কারণে কাজ করানো যাচ্ছেনা। এই অবস্থায় সময় বাড়ানোর জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য সভা করেছে জেলা কাবিটা বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি। আগামী রোববার এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কাজের অগ্রগতির সরকারি প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে সাংবাদিক সম্মেলন করে ৬০ ভাগ কাজও হয়নি বলে দাবি করেছেন হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। তারা কাজে বিলম্বে ক্ষোভ প্রকাশ করে নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ত্রুটিগুলো তুলে ধরেছেন। সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বলেছেন কাজের শুরু থেকেই তারা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতসহ নানা দাবি জানালেও সংশ্লিষ্টরা কর্ণপাত করেননি।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার দাস রায় বলেন, পিআইসি গঠন থেকেই দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি শুরু হয়েছিল। তাছাড়া বিলম্বে পিআইসি গঠন করায় কাজেও বিলম্ব হয়েছে। যে কারণে যথাসময়ে এসে মাত্র ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে আমরা সরেজমিন ঘুরে জানতে পেরেছি। যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, এবার ফসলহানি ঘটলে সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারবেন না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূইয়া বলেন, কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তবে কিছু কারণে কয়েকটি বাঁধের কাজে সমস্যা হচ্ছে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কাজ করানো যায়নি। ফলে কাবিটা মনিটরিং ও বাস্তবায়ন কমিটি সময় আরো ১৫দিন বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করেছেন।