দেখার হাওর, নলুয়ার হাওর, চন্দ্রসোনারথাল, বাউরবাগ হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, সজনার হাইর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওর, জালিয়ার হাওর, বাওরবাগ, খরচার হাওর, পাথরচাউলি বা চেপটির হাওরের মত দেশের শত শত হাওরের আদি বৈশিষ্ট্যের সব জমিন প্রায় প্রতি বছরই পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে যায়। বাংলাদেশকে যদি ছয় ভাগ করা হয়, তার এক ভাগই হাওর জনপদ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি প্রশাসনিক জেলায় বিস্তৃত দেশের হাওরভূমি। প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখে পাহাড়ি ঢলে ধানী জমিন তলিয়ে গেলে এ নিয়ে কিছুদিন কথা হয়। গণমাধ্যম কিছু লেখালেখি ও প্রচার করে। তারপর আবারো সব নিশ্চুপ। আবার পরের বছরের চৈত্র মাসের তলিয়ে যাওয়া দিয়ে শুরু হয়। কেবল তর্ক চলে ফসলরক্ষা বাঁধ বানাতে কোথায় দুর্নীতি হয়েছে, কে কত ভাগ পেল কী পায়নি, কোন চেয়ারম্যান কত টাকা মেরেছে, কোন পিআইসি কাজ করেনি। কেউ কোনো দায়িত্ব নেয় না। দায় নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
হাওরের সুরক্ষা প্রশ্নটি কোনোভাবেই বাঁধ, ইজারা আর অবকাঠামোর সাথে জড়িত নয়। সংকটি উজান ও ভাটির উভয় অঞ্চলের। উজান মানে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে আর কোনো প্রাকৃতিক বন নেই এবং অন্যায়ভাবে খনিপ্রকল্প তৈরি হয়েছে। আরেকদিকে ভাটির বাংলাদেশ, যেখানে হাওর দখল ও দূষিত এবং এমনকী বাঁধ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে দমবন্ধ হয়ে মরছে।
একটা সময় চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখী থেকে শুরু করে অবিরাম বর্ষণ উজানের বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে ভাটিতে গড়িয়ে পড়তো। এসব পাহাড়ি বনে বুনো লতা, ঘাস, গুল্ম এবং বৃক্ষের আচ্ছাদন বৃষ্টির পানির ধারাকে দুম করে গড়িয়ে পড়তে বাধা দিত। পাহাড়ি বনের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ‘ছাঁকনি বা চুইয়ে পড়া নীতিতে’ উজান থেকে ভাটির হাওরে নামতো। ১৯৬০ সনের দিকে এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরও পাহাড়ি ঢলের এই নামতা হাওরবাসীর মুখস্থ ছিল।
এক একটি হাওর এক এক ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত। টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢল নামলে মাটিয়ান বা খরচার হাওর পর্যন্ত আসতে কত সময় লাগবে সেই হিসাব মানুষের ছিল। আকাশের নানা কোণে কী রঙের কী ধাচের মেঘ জমল তাই দেখে হাওরের বুড়িগুলো আগে আফালের হিসাব কষতে জানতো। এখন এসব বুড়িগুলোও নেই আর প্রবীণ জঙ্গলগুলোও নেই। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তের প্রাকৃতিক বনভূমি বিনাশ করে ভারত বহুজাতিক খনি প্রকল্প তৈরি করেছে। মেঘালয় পাহাড় আজ কয়লা আর চুনাপাথর তুলতে তুলতে ফাঁপা হয়ে গেছে। অল্প বিস্তর বৃষ্টিতেই আজ মেঘালয় পাহাড় ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের হাওরে। এখন উজানের পাহাড় থেকে ঢল নয়, নামে পাহাড়ি বালি ও পাথর-কাঁকড়ের স্তূপ। উজানের পাহাড়ি বালিতে হাওর ভাটির প্রায় নিম্নভূমি, জলাঞ্চল, বিল ও নদীগুলো আজ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হয়ে যাওয়া হাওরভূমিতে এখন বৃষ্টির পানি ধরে রাখবার মতো বৈশিষ্ট্য নেই। তাই অল্প বৃষ্টি, এমনকি চৈত্রের প্রথম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় হাওর। প্লাবিত হয়, মূলত বৃষ্টির জল কোথাও প্রবাহিত হতে না পেরে হাওর ভূমির কৃষি জমিতেই ছড়িয়ে পড়ে, প্লাবিত হয়। তাই মূলত ডুবে যায় হাওরের ধান জমিনগুলো। মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়েই দুনিয়ার এক বিশেষ বন অবস্থিত। বালফাকরাম সংরক্ষিত বনভূমি। বালফাকরামের ভাটিতে কিন্তু পাহাড়ি ঢলে এখনো তলিয়ে যায় না সেখানকার নিম্নাঞ্চল। এ তো গেল উজানের কথা, ভাটিতে কী তাহলে জলপ্রবাহের অংক ঠিক আছে? না ভাটিতেও উজানের মতই প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহকে গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে। ভাটির বাংলাদেশ সবগুলো হাওর ধনী ও প্রভাবশালীদের ইজারা দিয়ে হাওরকে বানিয়ে রেখেছে বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। যে পাহাড়ি বালি হাওরের জন্য আজ অন্যতম প্রধান সমস্যা সেই পাহাড়ি বালি-পাথর বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একদল মুনাফাখোর। এরা মনেপ্রাণে চায় মেঘালয় পাহাড় ভেঙে হাওর ভরাট হয়ে যাক এবং বছর বছর তলিয়ে যাক। উজানের খনি ব্যবসায়ী ও ভাটির ইজারাদারেরা মূলত একই নয়াউদারবাদী করপোরেট মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। ভাটির বাংলাদেশে হাওর ইজারা নিয়ে প্রাকৃতিক জলাভূমিতে আগ্রাসী হাইব্রিড বিপজ্জনক মাছদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হাওরের নানা জায়গায় বান দিয়ে জলতরঙ্গ আটকে দেয়া হয়েছে। হাওরের নদী ও প্রবাহগুলোকে আটকে দেয়া হয়েছে। মানে হাওরের উজান ও ভাটি আজ সবখানেই সব দিকে থেকে বন্ধ, শৃংখলিত ও আবদ্ধ। তাহলে কী বৃষ্টি হবে না? পানির ধর্ম বদলে যাবে? পানি তো উজান থকে ভাটিতে গড়াবেই। তাহলে উজান থেকে ভাটিতে বৃষ্টির ঢলকে গড়িয়ে যাওয়ার পথগুলো বারবার বন্ধ করে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বারবার করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই হাওরের সুরক্ষা দিতে পারেনি। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। হাওরের এই উজান-ভাটির অংকটি সচল রাখার দাবি কোনোভাবেই আজকের নতুন নয়, ভাসান পানির আন্দোলনেরও আগ থেকে হাওরবাসী এই দাবি করে আসছেন।
নয়াউদারবাদী মুনাফার ময়দানে জিম্মি হয়ে আছে হাওর। পাহাড়ি ঢলে হাওরের এই তলিয়ে যাওয়া বিষয়টি পুরো একটি আন্তঃরাষ্ট্রিক সংকট। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই এক বহুপক্ষীয় জলাভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়েই কেবল এর সুরাহা সম্ভব। কারণ এখানে উজান ও ভাটির প্রশ্নটি পর¯পরনির্ভরশীল। কিন্তু এসব আমরা কখনো বিচার করছি না। হাওরের অভিন্ন নদী নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন কখনোই কোনো ন্যায়বিচার করেনি। তাহলে কীভাবে হবে? চৈত্র-বৈশাখে তো হাওর তলিয়েই যাবে। কারণ ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্র যে উন্নয়ন বাণিজ্য চালু রেখেছে তাতে হাওর বছর বছর ডুববে। আর হাওরবাসী দিন দিন হাওর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। হাওরে জনমিতির এক ভয়াবহ ধস নামবে। বছর বছর হাওর তলিয়ে গেলেও রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এর পূর্ণাঙ্গ কোনো তদন্ত, হদিস ও গবেষণা করে না। কেউ দায়িত্ব নেয় না, দায় স্বীকার করে না। অথচ হাওর ও জলাভূমি উন্নয় বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। জনগণের পয়সায় এটি চলে। কিন্তু বছর বছর পানিতে হাওর তলিয়ে গেলেও এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো চেহারা কোথাও দেখা যায় না। ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখে এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠিত হয় এবং ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে পানিস¤পদ মন্ত্রণালয় ১১ সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে এক রিজলিউশনের মাধ্যমে দেশের সকল হাওর ও জলাভূমি সমন্বিতভাবে উন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পুনরায় ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’কে পানিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত অফিস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন (নং পাসম-উঃ৫/বিবিধ-১৯/২০০০/৩৮৩, সূত্র : বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, ২৬/৯/২০০০)।
২০১২ সনের এপ্রিলে প্রকাশিত তিন খ-ের এই হাওর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনাটি ৬টি ধাপে প্রস্তুত করা হয়েছে। হাওর বিষয়ক কোনো বিশেষ নীতি ও ঘোষণা এখনো আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখতে পাইনা।
হাওর অঞ্চলে ধান ঋতু মূলত একটাই। বোরো মওসুম। চৈত্র মাসে ধান কাটা শেষ হয়, বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ জুড়ে চলে ধানের কারবার। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ এ সময় জুড়ে হাওর এলাকা প্রধান কর্মউৎসবের নাম ‘বৈশাখী’। বৈশাখীতে ঘরে তোলা ধান বেঁচেই বছরের খোরাক এবং নানা দেনা-পাওনা শোধ করতে হয়। কৃষিমজুরের বেতন থেকে শুরু করে রাখালের মজুরি। নৌকা খেয়াঘাটের বছরভর যাতায়াতের খরচ কী হিরালের পাওনা সব শোধ করতে হয়। কিন্তু যে বছর হাওরের ধান তলিয়ে যায় সে বছর আর বৈশাখী হয় না।
হাওর কী কেবলই ধান, মাছ আর পানির বিষয়। আবার যখন সিলেটে বিশাল আয়োজনে ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ সিলেট সাংস্কৃতিক উৎসব করে তখন তো রাধারমণ, হাসনরাজা কী শাহ আব্দুল করিম ছাড়া চলে না। হাওরের সংস্কৃতিকে ‘উদ্ধার করতে’ যেন দম ফুরিয়ে যায়। কিন্তু রাধারমণ কী করিমের জমিন জিরাত যখন তলিয়ে যায় পাহাড়ি ঢলে তখন কোথায় থাকে এইসব তথাকথিত ‘সাংস্কৃতিক দরদ’? তার মানে আমরা ¯পষ্টত দেখতে পাই ১৯৫০ সন থেকে কেউ হাওরের উজান-ভাটির জীবন ঘিরে দাঁড়ায়নি। বলা ভাল দাঁড়াতে চায়নি। হাওরে এমনি এমনি যেমন কোনো ধানের জন্ম হয়নি, এমনি এমনি কোনো গানের জন্ম হয়নি। ধান, গান আর জলমাটির প্রাণ মিলেই হাওরের জটিল সংসার। এই সংসারের উজান ও ভাটির গণিত বুঝতে হবে। তলিয়ে যাওয়া হাওরের তলে দাঁড়িয়ে হাওরবাসীর চোখেই এই সংকটের মোকাবিলা করতে হবে।
[লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ]