গতকালের দৈনিক সুনামকণ্ঠের প্রথম পাতার ১১টি শিরোনাম সমগ্র বিশ্বসহ বাংলাদেশকে প্রতিস্থাপন করেছে। অক্সফাম বলেছে, বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেক (৩৮০ কোটি) মানুষের মোট সম্পত্তির সমান সম্পদ রয়েছে বিশ্বের ২৬ জন শীর্ষ ধনীর হাতে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে কোনও মূল্যে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে দেশে। বলতে গেলে অসম্ভব একটি প্রত্যয়ের ঘোষণা। কিন্তু বাংলাদেশকে এর ভেতর দিয়েই অতিক্রম করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেমন জানেন, দেশের মানুষও তেমনি জানেন, এর কোনও বিকল্প নেই। তাই তাঁর ঘোষণা ‘এ ক্ষেত্রে কোনও আপস নেই।’
তাছাড়া একদিকে সংবাদ বেরিয়েছে যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে বিএনপি এবং অপরদিকে যথাসময়ে দুর্নীতিমুক্ত উপায়ে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ সম্পন্ন করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।
এরকম সংবাদ একত্রে এক পাতায় সন্নিবেশিত হলে মগজে এক ধরনের প্রচ- প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। মনে হয় অর্থনীতি এমন একটা প্রপঞ্চ (সমাজবাস্তবতা) যা মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করেই নিজের অস্তিত্বকে সচল রাখে এবং আন্তর্জাতিক থেকে শুরুর করে দেশীয়, দেশীয় থেকে স্থানীয় তৃণমূল পর্যন্ত সমাজ পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণের পরিধিটা অনেক বড় ও চূড়ান্ত অর্থে সাংস্কৃতিক এবং রাজনীতিক তো বটেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজমানসতা, শিল্পসাহিত্য এবং এমন কি আন্তর্জাল (সাইবারবিশ্ব) পর্যন্ত সব কীছুই এর নিয়ন্ত্রণের পরিধির মধ্যে পড়ে। আইএমএফ পদ্মসেতুর অর্থ ছাড় করে না, কোনও প্রশাসনে কাজ করে যে পিয়নটা সে কোটিপতি হয়ে যায় ক’দিনেই কিংবা জানা গেলো একজন শক্তিমান কবির পকেট একবারেই গড়ের মাঠÑ একবেলার অন্নের সংস্থান করার সামর্থ্য নেই, লুলা ভিখারিটা আলফাত চত্বরের একটিকে পড়ে থেকে যখন ভিক্ষা করছে তখন ভিডিও কনফারেন্সে বলা হচ্ছে, জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা আমাদের একমাত্র কাজ।’ অথচ এর দিনকয় আগে শাল্লার একজন প্রভাবশালী নিয়মবহির্ভূতভাবে জনপ্রত্যাশার মুখাগ্নি করে পিআইসি ভেঙে দিয়েছে এবং ভিখারি যথারীতি ভিক্ষা করতে ব্যস্ত। এই প্রপঞ্চগুলো আপাত সম্পর্কশূন্য এবং মনে হয় একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে। কিন্তু আসলে একটা কীছু সম্পর্ক অবশ্যই আছে। সে যাই হোক, এই প্রপঞ্চগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক প্রাথমিকভাবে ও প্রধানত অর্থনীতির নিরিখেই বিবেচ্য এবং চূড়ান্ত অর্থে মানবসমাজে অমানবিকতার আস্বভাবিকতার আবির্ভাবকে প্রতিপন্ন করে।
প্রচলিত অর্থনীতি মানুষের মধ্যে ধনবৈষম্য বাড়ায়, মানুষ অমানবিক হয়ে ওঠে, সমাজে অমানবিকতা বৃদ্ধি পায় এবং এতোটাই বৃদ্ধি পায় যে, তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া মাদকসক্তিকে অতিক্রম করে শিশুধর্ষণের মতো অবিমৃষ্যকারিতায় গিয়ে ঠেকে। আমাদের দেশে তাই হয়েছে। আমরা ঠেকাতে পারছি না এবং এই অপারগতাও প্রকারান্তরে আর্থনীতিক দুর্বলতারই নামান্তর। ধর্ষণ ঠেকানোর জন্য যে পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তার দরকার তা আমাদের নেই। এমনি সকল সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে আছি।
সম্প্রতি একজন বৈজ্ঞানিক ড. জহিরুল আলম সিদ্দিকী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির এক সান্ধ্যবৈঠকে বলেন, শিশুদেরকে মানবিক করে তোলতে হবে এবং আমাদেরকে বিদ্যমান ধনবৈষম্যতার চক্কর থেকে বেরিয়ে আসতে কিংবা একটি কল্যাণরাষ্ট্র জনগণকে উপহার দেওয়ার জন্য ভাবতে হবে, এবং এখনই নতুন একটি অর্থব্যবস্থা নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে। ভাবতে হবে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলোর অর্থব্যবস্থার কথা, জনকল্যাণমুখি রাষ্ট্রের কথা বা অন্য কিছু, পুরনোকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। সে মানুষই হোক আর অর্থনীতি।