‘অতিথি পাখি নিধনকে না বলি, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করি।’ এটি একটি আদর্শিক বাণী। রাজনীতিবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বুলি কিংবা জিগির বলা হয়। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে সংশ্লিষ্টরা যেটা তোতা পাখির মতো আওড়াতে আওড়াতে প্রচার করে থাকেন দিকে দিকে। অনেকটা আপ্তবাক্যের মতো। উদ্ধৃত বুলিটি পরিবেশবাদীদের একটি রাজনীতিক বুলি। আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরা বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত। তাঁরা সুযোগ পেলেই সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, আলোচনা, র্যালি, মানববন্ধন ইত্যাদি করেন। দেশের সর্বত্র এইসব কর্মকা- পরিচালিত হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, কোনও হাওরেই পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের তেমন কোনও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় না, ক্রমাবণতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয় না, সফলতার মুখ দেখে না পরিবেশবাদীদের কোনও কার্যক্রম। দিনে দিনে হাওরে হাওরে পরিবেশ দূষণের মাত্রা কেবল বাড়ছেই। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রাকৃতিক ভারসাম্যরক্ষাবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যবাহত আছে, ইদানিং তার সাথে যুক্ত হয়েছে পর্যটকবর্জ্যরে শিকার। এখানে পর্যটকরা আসেন এবং বিভিন্ন ধরণের অপচনশীল দ্রব্য ফেলে রেখে যান। এটা টাঙ্গুয়ার ভারসাম্যহীনতাকে ত্বরান্বিত করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
যাঁরা টাঙ্গুয়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থকেন তাঁরা ভালো করেই জানেন যে, এই বিলটিতে দেড় কোটি বছর আগের প্রাচীন পৃথিবীর প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখনও টিকে আছে। এই কারণে এই বিলটি বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ বলে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাঁরা এও জানেন যে, ইদাদিং এই প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মানবিক আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত, পরিবেশবাদীরা যাকে বলেন প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার শিকার, হচ্ছে ব্যাপকাকারে। বিভিন্ন প্রজাতির জীব ও উদ্ভিদ ইতোমধ্যেই হাওর থেকে নিশ্চিহ্ন গয়ে গেছে। জলাশয়ের মধ্যে বেরকুল, বামাশ যেমন এখন আর পাওয়া যায় না, তেমনি সজারু, মেছু বাঘ, ফেউয়ালি আর নেই। হাওরের ফাঁক-ফোঁকড়ে নেই যেমন হিজল-করচ গাছগাছালির জঙ্গল তেমনি নেই বিভিন্ন প্রকারের বৃক্ষ-লতা-গুল্ম ইত্যাদি। হাওর আসলেই আর আগের হাওর নেই। আগের দিনে হাওরে বিশেষ করে বিলের ভেতর দিয়ে লোকে নাও বেয়ে যেতো না। আশঙ্কা ছিল জল থেকে লাফিয়ে উঠা রউয়ের গুতোয় নাওয়ের আরোহীর আহত এমনকি নিহত হওয়ার। কিন্তু আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের হাওরাঞ্চল সম্পূর্ণই বদলে গেছে। হাওরে যে-সম্পদ ছিল বর্তমানে বলতে গেলে তার কয়েক শতাংশও আর নেই।
অচিরেই টাঙ্গুয়াকে রক্ষা করার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন দরকার এবং সেই নীতিমালানুসারে টাঙ্গুয়াসহ হাওরাঞ্চল শাসন করা জরুরি এবং যাঁরা রক্ষণকাজে নিয়োজিত থাকবেন তাঁদেরকে অবশ্যই হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত।