‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।’ আসলে ব্যক্তি মানুষেরও। প্রায়ই বালা হয় কথাটা। যার তার মুখে উচ্চরতি হয়, যখন তখন। এমন কেউ হয় তো নেই যিনি, ছাত্রাবস্থায় এই বহুল প্রচারিত বাক্যটির ভাবসম্প্রসারণ করেননি। কিন্তু অতিকথনেও এই বিখ্যাত বাক্যটির ধার একটুও ক্ষয়ে যায় না, বরং দিনে দিনে বাড়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এই বাক্যটির ধারকে কমিয়ে দিতে ইংরেজরা ভারতবর্ষে মেকলে শিক্ষানীতি চালু করেছিল। যে-শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল, এক শ্রেণির ভারতীয় শিক্ষিত লোক তৈরি করা, যারা রক্তমাংসে ভারতীয় হলেও মনে-মগজে ও চিন্তা-চেতনায় হবে ইংরেজ। সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা হবে দু’মাছলা মেরুদ-হীন মানুষ। এই শিক্ষিতরা ইংরেজের পক্ষ থেকে ভারতীয়দেরকে প্রয়োজনে ঠেঙ্গিয়ে সোজা করে রাখবে এবং ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসন ও শোষণ বহাল থাকবে পুরোদমে। এই কারণে ঔপনিবেশিকতার নিগড় ভাঙার প্রেরণা থেকে ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-’ কথাটির অনুশীলন ও জাতীয় জীবনে বাস্তবে কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা সব সময়ই ছিল এখনও আছে। এর বিকল্প কোনও দিনই ছিল না এবং বর্তমানেও নেই।
সাধারণ মানুষকে মেরুদ-হীন অর্থাৎ শোষণ ও শাসনের যোগ্য করে রাখতে হলে তাদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখাই সবচেয়ে কার্যকর পন্থা। শিক্ষায় পশ্চাদপদ জনসাধারণের সঙ্গে রাজনীতিক প্রতারণা সহজে করা যায়। এই সত্যটি আমাদের দেশের একশ্রেণির প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকরা বেশ ভালো করেই জানেন। তারা ক্ষমতায় গেলে দেশের সাক্ষরতার হার কমে, কমে উন্নয়নের গতি, বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে অস্ত্রাগার। দিনে দিনে দাম বেড়ে গরিবের ক্রয়ক্ষমতার বাইরের একটি পণ্য হয়ে ওঠে শিক্ষা। এইভাবে জাতীয় ক্ষেত্রে শিক্ষার সংকোচন ঘটে। দেশে প্রতীকী অর্থে সত্যিকারভাবেই মেরুদ-হীন মানুষের সংখ্যা বাড়ে। শোষণ ও শাসন করার সুবিধা বাড়ে বিশেষ এক শ্রেণির মানুষের। এইভাবে এই বিশেষ প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণি বঙ্গবন্ধুর সেনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নকে নস্যাৎ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের রাজনীতি করে চলে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা মানে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত ও শিক্ষিত মানুষের বাংলাদেশ, শিক্ষার শিক্তিতে শক্ত মেরুদ-ওয়ালা মানুষের দেশ, ভণ্ড রাজনীতিক প্রতারকরা যে-দেশের মানুষকে ঠকাতে পারবে না।
গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সম্মেলন ২০১৮-এর অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে শিক্ষার শিক্তিতে শক্ত মেরুদ-ওয়ালা মানুষের দেশ তৈরির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করে দেবেন। যাতে শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব এলাকার বাইরে না গিয়ে সহজে শিক্ষা অর্জন করতে পারে। আমরা তাঁর এই মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নেরর জন্য অপেক্ষাপর এবং তাঁকে সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
সুনামগঞ্জ জেলা একটি হাওর-বেষ্টিত জলজসংস্কৃতির জেলা। এই জেলায় কোনও বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় অর্থে যা বুঝায় এখানে সে-রকম বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই জেলা প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশের একটি ব্যতিক্রমী জেলা। এখানকার জীববৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থাৎ এখানকার মৎস্য, ধান, ফলদ-কাষ্ঠল-অষধি বৃক্ষলতাগুল্ম ও পাথরকে প্রাধান্য দিয়ে বিশেষ প্রাযুক্তিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে পারে, যা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পক্ষে অনুকুল ভূমিকা পালন করবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সে-ভাবনাটাও ভেবে দেখতে বলি।