মো. শাহাদত হোসেন ::
আমরা ছোটবেলায় পড়েছি, গিনিপিগ নামে একটি প্রাণি আছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে এ প্রাণিটির উপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। বিশেষ করে, নতুন কোন আবিষ্কার মানব দেহে প্রয়োগের আগে গিনিপিগ বা অনুরূপ প্রাণির দেহে প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা হয়। এতে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া গেলেই শুধু সে আবিষ্কার মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়।
কিন্তু আমরা অবাক হই, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থাকতে বিজ্ঞানীদের গিনিপিগ সংগ্রহ করতে হয় কেন? আমরা, এ দেশের মানুষেরা সবসময়ই তো গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছি। প্রতিনিয়ত আমাদের উপর চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পুরো দেশটাই যেন এক গবেষণাগার, আর দেশের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা যেন এই গবেষণাগারে রাখা গিনিপিগ।
বাংলাদেশের শিশুদের উপর সিলেবাস আর পরীক্ষা নিয়ে যেভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে, পৃথিবীর আর কোন দেশে মনে হয় তেমনটি চলে না। কদিন পরপরই বই বদলানো হয়, পাঠ্যসূচি বদলানো হয়, পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানো হয়। যেন নতুন কিছুতে আমাদের খুব আগ্রহ। কিন্তু আসলে তো তা নয়। আমরা যথেষ্ট গবেষণা ছাড়াই, পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়াই একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করি। এরপর তার ভুল-ত্রুটি ধরা পড়লে আবারও যথেষ্ট গবেষণা ও যাচাই-বাছাই ছাড়াই আরেকটি পদ্ধতি গ্রহণ করি। আর এর ফলে যে একটি জাতি ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়ালই করি না। অথবা একটি জাতির উন্নয়ন বা ধ্বংসের চেয়ে নিজের সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছাকেই বড় মনে করি।
আমার দু’সন্তানের একজন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, আরেকজন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। কিই-বা আর বয়স তাদের। কিন্তু এর মধ্যেই তারা এবং তাদের মতো লক্ষ লক্ষ শিশু গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাদের বই ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়েছে একাধিকবার। আমি একজন শিক্ষক। তথাপি আমি নিজেও জানিনা তাদের পরীক্ষার সঠিক পদ্ধতিটা কেমন হবে। তাদের স্কুলের শিক্ষকরাও জানেন না। আমার ছেলে-মেয়েরা স্কুলের স্যারদের কাছ থেকে পরীক্ষা বিষয়ক প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমিও তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারি না।
আমি ভেবে পাই না, কেন বারবার পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাতে হবে? প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে তো পরীক্ষা পদ্ধতি বদলানোর দরকার নেই, পরীক্ষা পদ্ধতি উঠিয়ে দিলেই চলে। বিশেষ করে, পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা থাকার কোন যৌক্তিকতা নেই।
আমার সন্তান দু’টিই বই পড়তে পছন্দ করে। বই মানে গল্পের বই, খেলার বই, বাংলাপিডিয়া অর্থাৎ অপাঠ্য বই। কিন্তু তারা এবার পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে বলে তাদের মা তাদেরকে এবার সেসব বই পড়তে দিচ্ছে না। কেননা পঞ্চম শ্রেণিতে আছে পিইসি এবং অষ্টম শ্রেণিতে আছে জেএসসি পরীক্ষা। যেহেতু দু’টো পরীক্ষাই পাবলিক পরীক্ষা, সেহেতু তাদের মায়ের দাবি, এ পরীক্ষায় তাদের ভালো ফলাফল করতে হবে।
কিন্তু ভালো ফলাফল করাতে গিয়ে আমরা যে লক্ষ লক্ষ শিশুকে ভালো মানুষ হওয়া থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি- সে হিসাব করছি না। পৃথিবীর কোন শিক্ষাবিদ কি আছেন, যিনি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্যে পাবলিক পরীক্ষা চালুর পক্ষে মতামত দিয়েছেন? পরীক্ষা পদ্ধতি কি কোন শিশুর জ্ঞান বিকাশে সাহায্য করে? পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা শিশুই কি ভালো মানুষ হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর তো আমাদের সবারই জানা। তারপরেও কেন আমরা পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা চালু করেছি?
বাংলাদেশ তো আর পিছিয়ে পড়া কোন দেশ নয়। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করেছে। এখন দেশটাকে আমরা একটি সুন্দর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আর সেজন্যে দরকার সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সুন্দর মানুষ তৈরি করা। শিক্ষার লক্ষ্য হলো সৎ, বিবেকবান, পরমতসহিষ্ণু, বিজ্ঞানমনস্ক ও দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শিশু স্কুলে ও বাসায় আচার-ব্যবহার, সততা, সামাজিকীকরণ, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম এসব বিষয় শিখবে। স্কুলে তো বছর শেষে পরীক্ষা হচ্ছেই আর সেখানেই যাচাই হচ্ছে, সে তার কাক্সিক্ষত শিখনফল অর্জন করতে পারছে কিনা। সেজন্যে তো তার পাবলিক পরীক্ষায় বসার দরকার নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব দেশ অন্যান্য দেশের পথিকৃৎ, পৃথিবীর এমন অনেক দেশেই পঞ্চম/অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোন পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় না। কই, তারা তো কম মেধাবী হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে না।
তাই একটি সুন্দর দেশ, সুন্দর সমাজ গঠনের জন্যে একটি যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা সম্ভব।
বর্তমানে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লক্ষ পরীক্ষার্থী প্রতি বছর পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর আমরা যদি প্রতিনিয়ত পরীক্ষার নামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকি, তাহলে জাতির ভবিষ্যত যে অন্ধকার- তা বলার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।
আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাই আমাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে আজকের শিশুদেরকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর সেজন্যে পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণির পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা গ্রহণ স্থগিত করতে হবে। অধিকন্তু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ঘন ঘন পরিবর্তন না এনে একটি যুগোপযোগী ও দীর্ঘস্থায়ী পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, যে কোন পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করে, গবেষণা করে, সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়ে এবং পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করে তা প্রবর্তন করতে হবে।
[লেখক মো. শাহাদত হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ, সুনামগঞ্জ।]