1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:১৬ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

শেষ পর্ব : ভাষা আন্দোলন ও সুনামগঞ্জের ছাত্রসমাজ

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

কল্লোল তালুকদার চপল ::

আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়
ভাষা আন্দোলনের ঢেউ সুনামগঞ্জের মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আঘাত হানে। উত্তাল হয়ে উঠে রাজপথ। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে এখানকার ছাত্রজনতার গৌরবজনক ভূমিকা নিয়ে আশানুরূপ লেখালেখি হয়নি। প্রায় ৪০ বছর পর স্থানীয় সাপ্তাহিক ‘স্বজন’ এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ নেয়। আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের অধিকাংশই তখন আর পৃথিবীতে নেই। তখন পর্যন্ত যেটুকু লেখালেখি হয়েছে, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয়েছে বিতর্কের। তাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে মোটামুটি একটি চিত্র তুলে ধরার অভিপ্রায়ে তখনকার সময়ে জীবিত ভাষাসৈনিকদের বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করে পত্রিকাটি। স্বজনে প্রকাশিত দুটি লেখায় আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। তার মধ্যে একটি লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। লেখক সাপ্তাহিক স্বজনের সম্পাদক অ্যাড. শহীদুজ্জামান চৌধুরী’র মামা শাহ ফজলুল কুদ্দুস আহমদ। তিনি ছাত্রজীবনের পর আর রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসাবে অবসরে যান। অপর লেখাটি জননেতা আলফাত উদ্দিন আহমদের জবানীতে, যা প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালের ১ মার্চ। আলফাত উদ্দিন আহমদ (মোক্তার সাহেব হিসাবেও তিনি পরিচিত) ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে আমৃত্যু গণমানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করেছেন।
দুটি লেখাই তথ্য বহুল এবং সুনামগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’জনের বক্তব্যে মতান্তর ঘটেছে। দীর্ঘদিন পর স্মৃতিনির্ভর লেখায় তথ্যের কিছু কিছু গড়মিল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাঁদের দু’জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে উপরিউক্ত লেখা দু’টির মতানৈক্যের জায়গাগুলোতে ঐক্য স্থাপনের একটা প্রয়াস করা হয়েছে বর্তমান লেখায়। এ ক্ষেত্রে নির্ভর করা হয়েছে প্রধানত আন্দোলন চলাকালীন প্রকাশিত নও-বেলাল পত্রিকার উপর। কেবল সিলেট অঞ্চলে নয়, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনেও সাপ্তাহিক নও-বেলাল পত্রিকার অবদানের কথা অনস্বীকার্য। সুনামগঞ্জের আন্দোলনের খুঁটিনাটি খবরও এই পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে।
‘কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি অব অ্যাকশন’-এর উদ্যোগে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ও আরবি অক্ষরে বাংলাভাষা লিখন পদ্ধতি প্রচলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ববঙ্গে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং স্থানে স্থানে সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ দিন সিলেট জেলা রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে একটি বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। যুক্ত আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন সম্পাদক মাহমুদ আলী সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় সর্বস্তরের ছাত্রজনতা অংশগ্রহণ করেন। ছাত্র আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও তা অচিরেই গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করে।
কিছুটা দেরিতে হলেও আন্দোলনের এই ঢেউ প্রান্তিক জনপদ সুনামগঞ্জের ছাত্র-জনতাকেও চঞ্চল করে তুলে। আলফাত উদ্দিন সাহেবের ভাষ্য মতে, ২১ তারিখের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি সুনামগঞ্জেও পালিত হয়। তিনি বলেন, “সুনামগঞ্জেও এদিন টাউন হল প্রাঙ্গণে (বর্তমান টাউন হল মার্কেট) প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আব্দুল হাই। ২১ তারিখেই ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। আহ্বায়ক ছিলেন আব্দুল হাই। সদস্য ছিলেন আব্দুল হক, আলতাফ উদ্দিন, নূরুল আবেদীন (বিন্নাকুলি, তাহিরপুর), নূরুল হুদা (তখন স্কুলছাত্র), আলাউদ্দিন (প্রকৌশলী, তখন স্কুলছাত্র), তজম্মুল হোসেন (কাঁচা মিয়া)। আন্দোলনে দেওয়ান ওবায়দুর রেজা, হুসেন বখত, আবু মিয়াসহ আরো কয়েকজন যুবক ভালো ভূমিকা রাখেন”। অবশ্য নও-বেলাল পত্রিকায় (৬ মার্চ ১৯৫২ খ্রি.) উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সুনামগঞ্জে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি।
সুনামগঞ্জ শহর তখনও বলতে গেলে একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। শহরে তখনও বিজলী বাতি আসেনি। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কাজেই ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত হওয়ার খবর এখানে আসে বেশ দেরিতে। ঠিক কখন সংবাদ পৌঁছে এবং সেই খবর পাওয়ার পর এখানে কী কী প্রতিক্রিয়া হয়, সে সম্পর্কেও রয়েছে মতপার্থক্য। শাহ ফজলুল কুদ্দুস আহমদ লেখেন, “বর্তামন সময়ের মত তড়িৎ গতিতে কোনো সংবাদ সরবরাহের ব্যবস্থা তখন ছিল না। টেলিভিশনের তো কোনো প্রশ্নই উঠে না। সারা সুনামগঞ্জে তখন একটি রেডিও ছিল না। পত্রিকা পেতে সময় লাগত কমপক্ষে ৩ দিন। সঠিক সংবাদ এখানে পৌঁছতে সময় লেগে গেল ২ দিনেরও অধিক। বিলম্বে হলেও যখন এ সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌঁছল তখন কিছু নেতৃস্থানীয় ছাত্র শোকসভা ও শোকমিছিল করার মনস্থ করলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে সভা করার কোনো সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কতিপয় ছাত্রের মধ্যে ঘরোয়া আলোচনার পর একটি গোপন স্থানে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। কারণ প্রকাশ্যে সভা করাতে তখন শুধু যে সরকারের ভয় ছিল তেমন নয়। অভিভাবক ও শিক্ষকদের ভয়ও ছিল সমধিক। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ শহরের দক্ষিণ দিকে মরাটিলার কাছে একটি গাছের নীচে, যেখানে দিনের বেলায় শিয়াল ডাকত এবং কেউ যেত না সেখানে পরদিন বিকাল বেলা একটি আলোচনা বৈঠকে মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
“প্রোগ্রাম অনুযায়ী যথাসময়ে আমরা গিয়ে সমবেত হলাম সেখানে। উপস্থিতির সংখ্যা সর্বমোট ১৫/২০ জনের বেশি ছিল না। বিশদ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো পরদিন বিকালে পুরাতন কলেজ প্রাঙ্গণে একটি শোকসভার অনুষ্ঠান হবে এবং সভা শেষে নগ্নপদে একটি শোকমিছিল করা হবে।”
“পরদিন বিকাল ৩ ঘটিকার সময় অনেক প্রতিকূল অবস্থার ভিতর দিয়েও সভার ব্যবস্থা করা হলো কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য নেতৃস্থানীয় কাউকেই রাজি করানো গেল না। অবশেষে তাহিরপুর থানার বিন্নাকুলি নিবাসী আসাম প্রাদেশিক পরিষদের প্রাক্তন এমএলএ মকবুল হোসেন চৌধুরী অসুস্থ অবস্থায় সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সভায় উদ্বোধনী ভাষণের পর জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন আব্দুল হাই, আব্দুল হক, গোলজার আহমদ, মো. শামছুল হক, আলাউদ্দিন আহমদ ও আশরাফ আলী প্রমুখ। সভা শেষে নগ্নপদে একটি মিছিল বের করে শহরের প্রধান রাস্তাগুলি প্রদক্ষিণ করা হয়।”
“তারপর ঢাকা থেকে আগত ছাত্রনেতা আব্দুস সামাদ ও আব্দুল হাই এসে সভানুষ্ঠান করেন এবং ছাত্র-জনতার কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার উদ্ধৃতি সহকারে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তুলে ধরেন।”
এছাড়াও শাহ ফজলুল কুদ্দুস আহমদ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় কারা ছিলেন সে সম্পর্কে লেখেন, “ছাত্রআন্দোলনের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় যারা বিশেষ অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে জামালগঞ্জ থানার মৌলীনগর নিবাসী আব্দুর রসিদ, মো. আব্দুল হক, মো. কুটি মিয়া, গোলজার আহমদ ও আশরাফ আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।”
কিন্তু মোক্তার সাহেব উপরিউক্ত বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি স্মৃতিচারণ করেন, “সে সময় ঢাকার পত্রিকা একদিন পর সুনামগঞ্জ পৌঁছত। ২১শে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনা পত্রিকার মাধ্যমে সুনামগঞ্জে পৌঁছামাত্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দৈনিক আজাদের রিপোর্ট পড়ে বিক্ষুব্ধরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। মিছিল শেষে টাউন হল প্রাঙ্গণে সভায় আব্দুল হক, আব্দুল হাই বক্তৃতা করেন। ঘোষণা দেন পরদিন হরতাল হবে। পাকিস্তানের প্রথম এই হরতাল সর্বাত্মক পালিত হয়। বিকেলে সেই একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় বিরাট প্রতিবাদ সভা। এতে প্রায় ১ হাজার লোক ছিলেন। তখন মিটিং এতো লোক হত না। এই মিটিংয়ের বিশেষত্ব ছিল ঢাকার ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা মেডিকেলের মেধাবী ছাত্র ডা. আবুল লেইছ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আফাজ উদ্দিন (বর্তমানে ব্যবসায়ী) বক্তৃতা দেন। পরদিনও মিটিং হয়।
“২৪ ফেব্রুয়ারি ’৫২ টাউন হল প্রাঙ্গণে বিরাট সভা চলার সময় নূরুল আমীনের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী আব্দুল খালেক আহমদ, মফিজ সাব গং মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ সেখানে হাজির হন। তারা বক্তৃতা দেয়ার আবেদন জানান। তাতে সভার উদ্যোক্তারা রাজি হলে খালেক সাহেব বক্তৃতা শুরু করেন। এ সময় জনতা হৈ চৈ শুরু করে। খালেক সাহেব নূরুল আমীনের সাফাই গাইতে শুরু করলে জনতা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলে বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখেই তারা চলে যান”।
মোক্তার সাহেব আরো যোগ করেন, “আন্দোলনকে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য গ্রাম্য হাট-বাজারে মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। নোয়াখালী বাজার, পাথারিয়া, পাগলা, জয়কলস, আমবাড়িসহ আরো কয়েক স্থানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সভা হয়। জনসভাগুলোতে সুনামগঞ্জ থেকে আব্দুল হাই, আবদুল হক, আলফাত উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন যেতেন।”
আব্দুর রশীদ, গুলজার আহমদ ও মকবুল হোসেন চৌধুরী’র সুনামগঞ্জে ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়ে শাহ ফজলুল কুদ্দুস আহমদ যে-তথ্য উপস্থান করেন, সে বিষয়ে আলফাত উদ্দিন সাহেব দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, আব্দুর রশীদ সাহেব পাকিস্তান আন্দোলনে খুব ভালো ভূমিকা রাখেন। পরে গ্রামের স্কুলে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। গুলজার আহমদ ও মকবুল হোসেন চৌধুরী সম্পর্কে তিনি বলেন যে, তাঁরা দু’জন আন্দোলনের সময় সিলেট থাকতেন।
প্রকৃতপক্ষে দেশবিভাগের পূর্বে ছাত্রনেতা আব্দুর রশীদ এবং ৬ষ্ঠ দশকের শেষভাগ থেকে গুলজার আহমদ ছিলেন সুনামগঞ্জের ছাত্র রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। গুলজার আহমদ কেবল সুনামগঞ্জে নয়, বৃহত্তর সিলেটেও পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। এসব কারণেই হয়তো দীর্ঘকাল পর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহ ফজলুল কুদ্দুস আহমদ এই দু’জন প্রভাবশালী ছাত্রনেতার নাম সুনামগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ভ্রান্তি বশত জড়িত করে থাকতে পারেন। গুলজার আহমদের নিজের লেখা থেকেই নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় সুনামগঞ্জ ছিলেন না। তিনি ১৯৫৫ সালে সুনামগঞ্জ আসেন। তখনও তিনি মেট্রিক পাস করেননি। প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে হাইয়ার সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে তিনি মেট্রিক পাস করেন ১৯৫৬ সালে।১৪ উল্লেখ্য, ১৯৬০-৬১ শিক্ষাবর্ষে সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থিত ভ্যানগার্ড গ্রুপ থেকে গুলজার আহমদ জি.এস. নির্বাচিত হন। তাছাড়া ছাত্রনেতা আব্দুর রশীদ সাহেবও সম্ভবত তখন সুনামগঞ্জে ছিলেন না। আসাম আইন অমান্য আন্দোলনের সময় আব্দুর রশীদ ছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট। ’৪৭-এর গণভোটের আগেই তিনি সিলেটে চলে যান এবং সেখানেও রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করেন। ১৪ আগস্ট ১৯৪৯ সালের সাপ্তাহিক নও-বেলাল পত্রিকার স্বাধীনতা সংখ্যায় তৎকালীন ছাত্রনেতা মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ (আজাদ) ‘মুসলিম ছাত্রদের ভূমিকা’ শিরোনামে যে প্রবন্ধ লিখেন, তাতে আসাম আইন অমান্য আন্দোলনে আব্দুর রশীদ সাহেবের সাহসী নেতৃত্বের ভূয়শী প্রশংসা করেন। তবে মকবুল হোসেন চৌধুরী যে তখন সুনামগঞ্জে ছিলেন এবং একটি সভায় সভাপতিত্ব করেন তা নও-বেলালের পরিবেশিত সংবাদ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ঢাকার হত্যাকা-ের খবর পাওয়ার পর সুনামগঞ্জের ছাত্রসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সুনামগঞ্জ কলেজ, জুবিলী হাই স্কুল ও বুলচান্দ হাই স্কুলের ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসেন। স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ উত্তাল হয়ে উঠে। স্লোগান চলতে থাকেÑ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অপরাধীদের গণবিচার চাই, নিরাপত্তা বন্দিদের মুক্তি চাই, গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার চাই, জালিম শাহীর অবসান চাই প্রভৃতি স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। ঢাকার খবর যখনই এসে পৌঁছাক না কেন, বড়ো আকারে প্রথম প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আরম্ভ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। ৬ মার্চ ১৯৫২ সালের সাপ্তাহিক নও-বেলাল পত্রিকার রিপোর্ট থেকে তখনকার ঘটনাসমূহের ধারাবাহিক বর্ণনা পাওয়া যায়।
নও-বেলালের ভাষ্য মতে, যোগাযোগের অব্যবস্থার দরুণ ঢাকায় ছাত্রযুবক জনতার উপর অমানুষিক গুলিবর্ষণের সঠিক সংবাদ সুনামগঞ্জে অনেক পরে এসে পৌঁছে। সমস্ত শহর সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। সমস্ত স্কুল-কলেজ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ দিবস হরতাল প্রতিপালিত হয়। ৮টা হতে ১২টা ব্যাপী শোভাযাত্রা সহকারে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। স্থানীয় খেলার মাঠে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল হাই-এর সভাপতিত্বে এক সভায় ঢাকা শহর হতে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবি করা হয় এবং গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। নূরুল আমিন সরকার ও সমস্ত পরিষদ সদস্যের পদত্যাগ দাবি করেও প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই দিনই স্থানীয় কলেজ প্রাঙ্গণে (টাউন হল) বিকাল ৫টায় মকবুল হোসেন চৌধুরী’র সভাপতিত্বে আর একটি বিরাট প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকায় সরকারের পাশবিক অত্যাচারের প্রতিবাদে ২৪ তারিখ হতে প্রায় প্রতিদিনই সভা শোভাযাত্রা ও হরতাল অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ২৫ তারিখের এক সভায় ফ্যাসিস্ট মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণও কাজে যোগদান হতে বিরত থাকেন। বিকালে ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য মফিজ চৌধুরী’র সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ঢাকা হতে সদ্য আগত পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি আবদুল খালেক সাহেব ঢাকার মিথ্যা বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করলে জনসাধারণ তার তীব্র প্রতিবাদ করে ও নূরুল আমীনকে দালাল উল্লেখ করে স্লোগান দিতে থাকেন। সভাপতি যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ছাত্রআন্দোলন বলে উল্লেখ করেন তখন বিক্ষুব্ধ জনতা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “এই আন্দোলন ছাত্রআন্দোলন নয়, গণআন্দোলন”। যদিও প্রথমে ভাষা আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রসমাজ, কিন্তু পরবর্তীতে তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে। সে-কারণেই উপস্থিত জনতা সভাপতির বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন।
সভা শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে জনসাধারণ এম.এল.এ.দের পদত্যাগ দাবি করেন এবং এই মর্মে সভায় প্রস্তাব উত্থাপন করার জন্য জনসাধারণের পক্ষ হতে প্রতিনিধি অগ্রসর হলে সভাপতি তাঁকে বাধা দিয়ে সভা ভঙ্গ করে পালিয়ে যান। এই সভায় সুনামগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগের সভাপতি মকবুল হোসেন লীগ সরকারের জুলুমের প্রতিবাদে ঐ প্রতিষ্ঠান হতে পদত্যাগ ঘোষণা করলে উপস্থিত জনতা তুমুল হর্ষধ্বনি সহকারে তাঁকে অভিনন্দিত করে। পরদিন অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রগণ অফিস-আদালতে পিকেটিং করে। ফলে ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সেদিন কোনো কাজ হয়নি।
আন্দোলন দ্রুত গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। আমবাড়ি বাজারে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। শোভাযাত্রা সহকারে জনসাধারণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং সভা করে নুরুল আমীন সরকারের উচ্ছেদ দাবি করেন। জয়কলস বাজারেও সেদিন হরতাল পালিত হয়। জয়কলস মাদ্রাসা ও গোবিন্দপুর মাদ্রাসার ছাত্রগণ মিলিতভাবে সভা, শোভাযাত্রা, হরতাল ইত্যাদি পরিচালনা করেন। ঢাকার হত্যাকা-ের সংবাদ জগন্নাথপুরে পৌঁছার পর হতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হরতাল, সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। “অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমীন গদী ছাড়” প্রভৃতি ধ্বনি উঠতে থাকে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও জনসাধারণের উদ্যোগে জগন্নাথপুর বাজারে মৌলভি আজিজুল হক সাহেবের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দাবি করে, বর্তমান অযোগ্য মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভা শেষে জনসাধারণ পাঁচ মিনিট শহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করেন এবং সভায় গৃহীত প্রস্তাবসমূহের সারাংশ টেলিগ্রাম যোগে প্রধানমন্ত্রী বরাবর প্রেরণ করা হয়।
৬ মার্চ ১৯৫২ সালের সাপ্তাহিক নও-বেলালের শিরোনাম ছিল : ‘জনসাধারণের চোখের সম্মুখ হইতে সংশয়ের কৃষ্ণ যবনিকা অপসারিত’। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার রক্তে ঢাকার রাজপথ রক্তাক্ত হওয়ার প্রতিবাদে পত্রিকাটি লেখে, “ন্যায্য দাবি আদায়ের প্রতিজ্ঞায় অটুট সঙ্কল্পবদ্ধ শান্ত নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উপর লীগ-সরকারের বর্বরোচিত অত্যাচারে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে দেখা দিয়াছে অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ। ঢাকার পীচঢালা কালো রাজপথে শহীদ ভাইদের লাল তাজা রক্ত এতদিনের প্রতারিত, প্রবঞ্চিত, শোষিত জনসাধারণের চোখের সম্মুখ হইতে সংশয়ের কৃষ্ণ যবনিকা অপসারণ করিয়া আনিয়াছে চেতনার নূতন আলো। সেই চেতনার আলোতে প্রদীপ্ত জনতা আজ শুধু ঢাকায় নয়, নারায়ণগঞ্জে নয়, চট্টগ্রামে নয়, ময়মনসিংহে নয়, সিলেটে নয়, প্রতিটি জেলায়, শহরে, মহকুমায়, থানায়, ইউনিয়নে, গ্রামে আওয়াজ তুলিয়াছে “খুনি সরকার ধ্বংস হোক”, “অত্যাচারীর বিচার চাই”, “মুসলিম লীগে থাকবো না, গুলি খেয়ে মরবো না।”
ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নের বীজ বপন হয়ে যায় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। বাঙালির এই সংগ্রাম চলতেই থাকে এবং তা পরিপূর্ণতা পায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এই সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি জাগরণী ধবল প্রহরে সুনামগঞ্জের ছাত্রসমাজেরও রয়েছে আত্মত্যাগের স্বর্ণালী ইতিহাস। (সমাপ্ত)
তথ্যসূত্র :
১৪. গুলজার আহমদ, স্মৃতিচারণ, জননেতা আলফাত উদ্দিন স্মারকগ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র, সুনামগঞ্জ, ২০১৩ খ্রি.; পৃ. ২৩-২৫

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com